ভালবাসা: বাগবাজারের অনুষ্ঠানে বয়স্কদের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়ারা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
বিনা অনুমতিতে বাগান থেকে ফুল তুলছিলেন শাশুড়ি। সেই ‘অপরাধে’ তাঁকে বেধড়ক মারধর করছিলেন বৌমা।
বৃদ্ধ মাকে রেখে কয়েক দিনের জন্য ভিন্ রাজ্যে ঘুরতে গেলেন ছেলে। ঘরে রেখে গেলেন সামান্য খাবার।
ছেলের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করায় বৃদ্ধ বাবাকে মারধর করলেন ছেলে।
মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে এমন ছবি উঠে আসে। কিন্তু তা ‘হিমশৈলের চূড়ামাত্র’ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের মতে, সিংহ ভাগ ঘটনার কোনও রিপোর্টই হয় না। অন্তত বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট তেমনই বলছে।
আজ, শুক্রবার বয়স্কদের উপরে নির্যাতনরোধ সচেতনতা দিবস। ২০১২ সালের ১৫ জুন প্রথম বয়স্ক নির্যাতনরোধ সচেতনতা দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে রাষ্ট্রপুঞ্জ।
গড়িয়ার উত্তর বোড়ালের বাসিন্দা অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত বৃদ্ধা যশোদা পাল বাগান থেকে ফুল তুলছিলেন। অভিযোগ, সেই সময়ে তাঁকে বেধড়ক মারধর করেন পুত্রবধূ স্বপ্না পাল। ঘটনাটির ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ায় পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক পরে বুধবার যশোদাদেবীর বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল। শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলেও কখনও কখনও অসংলগ্ন কথা বলছেন তিনি। তাঁর চিকিৎসা তেমন ভাবে করা হয় না বলেই জানাচ্ছেন পরিজনেরা। তাঁদের দাবি, চিকিৎসা চললেও তাতে খুব বেশি কাজ হবে না। তাই তেমন ভাবে চিকিৎসা করা হচ্ছে না।
একটি সমীক্ষার রিপোর্টে উঠে আসছে, বয়স্কদের উপরে প্রতি ২৪টি নির্যাতনের মধ্যে একটি মাত্র ঘটনার অভিযোগ জমা পড়ে। কেন এই ধরনের ঘটনার অভিযোগ জমা পড়ে না, তার জবাবে দু’টি বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদ। দ্বিতীয়ত, কী ভাবে সমস্যার সমাধান করা যাবে, তা জানেন না অনেকেই। ফলে ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে সব সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না বলেই দাবি পুলিশকর্তাদের। সে কারণে সচেতনতার উপরেই ভরসা করতে হবে বলে মনে করছেন সমীক্ষকেরা। তাঁদের মতে, নির্যাতন মানে শুধুমাত্র মারধর নয়। বয়স্ক কোনও ব্যক্তিকে অবহেলা করাও নির্যাতন।
জীবনচর্চায় বদল এবং চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতির কারণে ২০৫০ সালে বিশ্ব জুড়েই বয়স্কদের সংখ্যা নবীনদের থেকে ছাপিয়ে যেতে পারে বলে মত এই সংক্রান্ত সমীক্ষাগুলির। ‘গ্লোবাল এজ ওয়াচ ইনডেক্স’ ৯৬টি দেশের বয়স্কদের বিষয়ে সমীক্ষা করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বয়স্কদের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারত ৭১ নম্বর স্থানে রয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভারত ৮৫ নম্বরে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা খুবই ‘হতাশাজনক’।
‘হেল্প এজ ইন্ডিয়া’র সমীক্ষা অনুযায়ী, বয়স্কদের উপরে নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রথম পাঁচটি শহরের মধ্যে রয়েছে দিল্লি। শীর্ষস্থানে রয়েছে মঙ্গলুরু। বয়স্কদের উপরে নির্যাতনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অভিযোগের আঙুল ছেলে এবং পুত্রবধূদের দিকে। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের বক্তব্য, ‘‘আমরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। এই ধরনের ঘটনার বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়ই। বয়স্কদের উপরে নির্যাতন কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।’’ তেমন ভাবেই মনোবিদ উশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সচেতনতা তো দরকার। কিন্তু ব্যক্তিস্তরে নবীন প্রজন্ম যদি দেখেন যে তাঁদের বাবা-মায়েরা বয়স্কদের সম্মান দিচ্ছেন, তাতে তাঁরাও সে ভাবেই ভবিষ্যতে বয়স্কদের সম্মান দেবেন। এমন ভাবে এগোলে বয়স্কদের উপরে নির্যাতন অনেকটা রোধ করা যেতে পারে।’’
বৃহস্পতিবার বাগবাজারের ‘ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রা ম়ঞ্চ’-এ বয়স্কদের উপরে নির্যাতনরোধ সচেতনতা দিবসের কর্মসূচি পালন করে রাজ্যের নারী ও শিশুবিকাশ এবং সমাজকল্যাণ দফতর। এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং বয়স্কেরা। সেখানেই তাঁদের সচেতনতার পাঠ দেন দফতরের পদস্থ আধিকারিকেরা।