বিপদ: এখনও কালো ধোঁয়ার বিষ ছড়িয়ে রাস্তায় ছুটছে বাস।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের আইন ও বিধি আছে। তা রূপায়ণ করার জন্য দফতর আছে। লোকলস্কর আছে। শুধু আইন মানার বা মানানোর সদিচ্ছা নেই। তাই দূষণ নিয়ে জেরবার মানুষ। দূষণজনিত সমস্যায় মৃত্যু বাড়ছে। জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ পর্যন্ত মানা হয় না। কিছু প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্র ও কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা ছাড়া সারা বছর পরিবেশ দফতরের অস্তিত্ব কার্যত দূরবীন দিয়ে দেখতে হয়। যদিও ঘটা করে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার ব্যাপারে দফতরের উৎসাহ দেখার মতো। আজ, সোমবার বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দেখা যাক, দূষণ সঙ্গে নিয়ে কী ভাবে বেঁচে আছে কলকাতার মানুষ।
ঠাসঠাস দ্রুম দ্রুম
এক সময়ে দিওয়ালি এলেই বাজির শব্দে বুক কাঁপত শহরের। শব্দবাজি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে সেই দাপট কতটা কমেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু দূষণ বাড়াতে হাজির হয়েছে নতুন অবতার ‘ডিজে বক্স’ (বিরাট মাপের সাউন্ডবক্স)। পুজো, বিসর্জনের শোভাযাত্রা বা বর্ষবরণের জলসা, অলিগলিতে ডিজে বক্সের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ হন মানুষ। পরিবেশ আইন বলছে, ডিজে নিষিদ্ধ। কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, পুলিশ-প্রশাসনের সামনেই নিষিদ্ধ ডিজে বাজে। সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন নেতা-মন্ত্রীরাও। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, ডিজে-র বিরুদ্ধে পুলিশ নিজে থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের হয়নি বলে দায় এড়ান তাঁরা। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই পুলিশকে এই ডিজে-তাণ্ডব বন্ধ করতে বলছেন। পথেঘাটে তো বটেই, খাস কলকাতায় হাসপাতালের সামনেও গাড়ির হর্নের দাপটে শব্দদূষণ মাত্রাছাড়া। তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় পরিবেশ আদালতও। চিকিৎসকেরা বলছেন, শব্দদানবের দাপটে মানুষজনের বধিরতা বাড়তে পারে। স্নায়ুরোগ, হৃদরোগ হওয়াও অসম্ভব নয়।
শব্দবাজিতে রক্ষা নেই। তার দোসর শোভাযাত্রায় তারস্বরে বাজা ডিজে।
ফুসফুসে বিষ...
বছর কয়েক আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে কলকাতা বায়ুদূষণে দ্বিতীয় হয়েছিল। তার পর থেকে বহু জল বয়ে গিয়েছে গঙ্গায়। ছবিটা বদলেছে কি? না। নিত্যদিনই বিষাক্ত ধোঁয়া গিলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। যা থেকে বাড়তে পারে হাঁপানি, ফুসফুস ও শ্বাসনালির ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি। পরিবেশবিদেরা বলছেন, গাড়ির ধোঁয়া, কংক্রিটের গুঁড়ো, জঞ্জাল পোড়ানোর মতো একাধিক উৎসই বিষিয়ে তুলছে বায়ু। কোন উৎস থেকে কতটা দূষণ হচ্ছে, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তা জানতে বিশেষজ্ঞ সংস্থা নিয়োগ করেছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। সেই রিপোর্ট আসতে আরও বছর দুয়েক। তার পরে দূষণ কমবে কি না সেটা যেমন প্রশ্ন, তেমনই প্রশ্ন দূষণের জেরে দেশে প্রথম হওয়া দিল্লিকে কি ঘায়েল করবে কলকাতা। মুচকি হাসছেন পরিবেশ দফতরের এক পদস্থ বিজ্ঞানী। বলছেন, ‘‘এখানে এপ্রিল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয় বলে কিছুটা রক্ষে। জলে বাতাসের ধুলো ধুয়ে যায়। ফলে বছরের কয়েক মাস সে ভাবে দূষণ ধরা পড়ে না। না হলে..।’’
ও গঙ্গা তুমি...?
বিখ্যাত গায়কের জনপ্রিয় গানকে কিছুটা প্যারডি করে এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন পরিবেশকর্মীরা। মধ্যযুগে বাঙালির বাণিজ্যের পথ আদিগঙ্গা বর্জ্য প়ড়ে, পলি জমে কার্যত নিকাশি নালায় পরিণত হয়েছে। তার পুনরুজ্জীবন নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতের বহু নির্দেশ রয়েছে। বিচারপতিরা সরেজমিন আদিগঙ্গার পরিস্থিতি দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জল পরীক্ষা করে আদালতে যা রিপোর্ট দিয়েছে তা থেকে স্পষ্ট ওই জলে জীবের বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। গঙ্গার পরিস্থিতি নিয়েও আশঙ্কিত পরিবেশবিদেরা। একে অপরিশোধিত নিকাশি ও বর্জ্য ফেলায় জল ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে। তার উপরে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই চলছে বেআইনি ভাবে বালি তোলা। ‘‘এতে শুধু ভূপ্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে না, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্রও’’, বলছেন এক নদী বিশেষজ্ঞ। কেন্দ্র গঙ্গা বাঁচাতে কতটা উদ্যোগী তা নিয়েও সংশয়ে পরিবেশকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় জলসম্পদ ও গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রী উমা ভারতী গঙ্গার ঘাটে পুজো করে গিয়েছেন। কিন্তু তাতে গঙ্গার কতটা কলুষমুক্তি ঘটেছে?
পাতালে কোপ, শুকোচ্ছে জলা...
নির্বিচারে মাটির তলার জল উঠছে শহরে। তার জেরে খালি হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলস্তর। বছর কয়েক আগে শুধু এই রিপোর্টেই থেমে থাকেননি পরিবেশবিদেরা। বলেছিলেন, ভূগর্ভের জলে টান পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ শহরতলিতে থাবা বসাচ্ছে বিষাক্ত আর্সেনিক। এই সমস্যা না মেটালে ভবিষ্যতে এই বিষ হবে মহামারী, সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তা প্রশাসনের মরমে কতটা ‘পশিছে,’ প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। যেমন শহরে আকছার জলা বোজানোর অভিযোগ মিললেও তা নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দখল হয়ে, শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জলাভূমি। সেখানে আরও নির্মাণ গজিয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা। সরকারও জলাভূমি বিধিতে বদল আনার চেষ্টা শুরু করেছে। পরিবেশ দফতরের বক্তব্য, পরিবেশের ক্ষতি না করে যতটা বদল আনা সম্ভব, ততটাই করা হবে।
বর্ষায় জলবন্দি শহরে খলনায়ক প্লাস্টিক। গালিপিটে জমে প্লাস্টিক। তাই নামে না জমা জল।
প্লাস্টিকের জ্বালা, ভাগাড়ে নাকাল...
৪০ মাইক্রনের থেকে পাতলা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। কিন্তু শহরের বাজারে রমরমিয়ে চলছে তা। প্লাস্টিক থেকে নিকাশিপথ বন্ধ হচ্ছে, একাধিক বার সে কথা স্বীকারও করেছে পুরসভা। বার কয়েক বাজারে হানাদারিও হয়েছে। কিন্তু ক’দিন মিটতেই ফিরে এসেছে পুরনো ছবি। শহর লাগোয়া হাওড়া ও দমদমের প্রমোদনগরে দু’টি মারাত্মক ভাগাড় রয়েছে। যাতে নিত্যদিনই আগুন লাগে, ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মানুষ। সমস্যার কথা জানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও। তারা বলছে, নতুন ভাগাড় করার জমি ও অর্থ নেই। ওই ভাগাড় বন্ধ করলে জঞ্জাল যাবে কোথায়? অতএব...
যা দেখছেন, লিখুন
রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী ও শহরের মেয়র একই ব্যক্তি। শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি এ নিয়ে বিশেষ কিছুই বলতে রাজি হননি। শুধু বলেছেন, ‘‘যা দেখছেন, লিখুন।’’
ছবি: সুমন বল্লভ ও ফাইল চিত্র