—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে যক্ষ্মা দূরীকরণের কর্মসূচি নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই পথে হেঁটে আগামী দু’বছরের মধ্যে রাজ্যের অন্তত ৭০ শতাংশ পঞ্চায়েত যাতে যক্ষ্মামুক্ত হয়, তার উপরে জোর দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরও। কিন্তু ‘যক্ষ্মামুক্ত বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা প্রতি পদে হোঁচট খেতে শুরু করেছে। কারণ, রাজ্যের ভাঁড়ারে যক্ষ্মা নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় কিট বা কার্ট্রিজের সংখ্যা শূন্য! যার ফলে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে জেলা ও মহকুমা হাসপাতালে যক্ষ্মা রোগী চিহ্নিতকরণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
সমস্যার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, যক্ষ্মা নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত উপযোগী পরীক্ষা হল ‘সিবি-ন্যাট’ (কার্ট্রিজ বেস্ড নিউক্লিক অ্যাসিড অ্যামপ্লিফিকেশন টেস্ট)। এই জিনগত পরীক্ষাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ডায়াগনস্টিক টেস্ট’। যদিও এর পাশাপাশি দেশীয় পদ্ধতির ‘ট্রু-ন্যাট’ পরীক্ষাও চালু রয়েছে। তবে, অধিকাংশ চিকিৎসকই ‘সিবি-ন্যাট’ পরীক্ষায় জোর দেন। কারণ, ওই পরীক্ষার রিপোর্ট যেমন দ্রুত পাওয়া যায়, তেমনই ফলাফল সম্পর্কে অনেক বেশি নিশ্চিত হওয়া যায়। জাতীয় যক্ষ্মা দূরীকরণ প্রকল্পে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যকে এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিট বা কার্ট্রিজ সরবরাহ করা হলেও গত দেড় মাস ধরে তা আসছে না। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘কেন্দ্র সরবরাহও করছে না। আবার কিনতেও দিচ্ছে না। অন্যান্য রাজ্যেও একই অবস্থা।’’
সমস্যার কথা জানিয়ে কেন্দ্রকে একাধিক বার চিঠি পাঠিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম। তিনি বলেন, ‘‘সিবি-ন্যাটের কার্ট্রিজের অভাবে যক্ষ্মা দূরীকরণ কর্মসূচিতে খুবই সমস্যা হচ্ছে।’’ গত বছরই স্বাস্থ্য দফতরের পর্যালোচনায় উঠে এসেছিল যে, রাজ্যে যক্ষ্মা রোগীর প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা কম। যার ফলে জাতীয় যক্ষ্মা দূরীকরণ কর্মসূচিতে সমস্যা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এখন যদি রোগ নির্ণয়ের পরিকাঠামোতেই ঘাটতি দেখা যায়, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই লক্ষ্যমাত্রা ধাক্কা খাবে বলে মত চিকিৎসকদের। সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, ‘‘যক্ষ্মা রোগ ধরতে কিংবা ওই রোগের মতো উপসর্গযুক্ত অন্য অসুখকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে এই জিনগত পরীক্ষা অপরিহার্য। এখন কার্ট্রিজ বা কিট পাওয়া না গেলে জাতীয় কর্মসূচি ধাক্কা তো খাবেই।’’
জানা যাচ্ছে, একটি সিবি-ন্যাট যন্ত্রে এক ঘণ্টায় চারটি নমুনা এবং ‘ট্রু-ন্যাট’ যন্ত্রে দু’ঘণ্টায় দু’টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তাই সিবি-ন্যাট পরীক্ষার উপাদান না থাকায় সর্বত্রই অপেক্ষমাণদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এবং রিপোর্ট পেতেও অনেক সময় লাগছে। এর ফলে অধিকাংশ সময়েই উপসর্গ বুঝে আন্দাজে যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, দেশের মোট যক্ষ্মা অক্রান্তের মধ্যে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গ ওই রোগে সংক্রমিত, এমন রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতিজাতীয় যক্ষ্মা ডিভিশনও বিষয়টির উপরে জোর দিয়ে সমস্ত রাজ্যকে নিয়ে বৈঠক করেছে। কিন্তু তার পরেও এমন হাল। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘বাইরে সিবি-ন্যাট পরীক্ষার খরচ দেড় হাজার টাকার বেশি। সেটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা দরিদ্রদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। আর ট্রু-ন্যাট পরীক্ষা বাইরে হয় না।’’
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই বললেন, ‘‘শুধু রোগ নির্ণয় নয়, কারও যক্ষ্মা প্রতিরোধী কি না, সেটাও সিবি-ন্যাট পরীক্ষায় জানা যায়। যার ফলে যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু যদি কিটের অভাবে সময় মতো পরীক্ষা করা না যায়, তা হলে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নতুন করে যক্ষ্মা আক্রান্তদের অন্তত ১০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বার আক্রান্তদের প্রায় ২৫ শতাংশের শরীরে ‘মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর) মেলে। এই প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় ‘ডিরেক্টলি অবজ়ার্ভড থেরাপি’ (ডট)-র ‘সেকেন্ড লাইন মেডিসিন’-এরও সর্বত্র জোগান পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, ‘‘রাজ্যে আপাতত এই ওষুধ রয়েছে।’’ যদিও চিকিৎসদের অধিকাংশেরই আশঙ্কা, অচিরেই সেটির ভাঁড়ারও শূন্য হবে না তো!