ডিসিল্টিং মেশিন। — নিজস্ব চিত্র
দিন কয়েক আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে জলভাসি হয়ে গিয়েছিল শহর কলকাতা। মূলত শহরের একাংশে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালায় পলি জমে থাকার কারণে কিছু এলাকায় ২-৪ ফুট পর্যন্ত জল জমে গিয়েছিল। কেন তোলা হয়নি পলি? তা নিয়ে পুরসভার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, পরিকাঠামো আরও বাড়াতে হবে। সেই দিকে নজর দিতে গিয়ে বেরিয়ে এল এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। শনিবার পুরসভার এক জরুরি বৈঠকে জানানো হয়েছে, বছর তিনেক আগে গোটা তিরিশেক ম্যানহোল ডিসিল্টিং মেশিন কিনেছিল কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প কেইআইআইপি। কিন্তু কখনওই তা কাজে লাগানো হয়নি। অথচ শহর জুড়ে অনেক জায়গাতেই পলি তোলা প্রয়োজন। তা হলে কেন ওই সব মেশিন এত দিন ব্যবহার করা হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পুর-মহলেই।
শনিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আবহাওয়া দফতর সতর্ক বার্তা দেওয়ার পরেই আগাম প্রস্তুতির জন্য পুর-প্রশাসনকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই প্রেক্ষিতেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় পুরসভার ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদ-সহ মেয়র পারিষদদের নিয়ে এক জরুরি বৈঠক করতে নির্দেশ দেন পুর-কমিশনার খলিল আহমেদকে। দুপুর দুটোর পরে শুরু হওয়া ওই বৈঠক চলে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে। সেখানে হাজির ছিলেন কেএমডিএ, সেচ, পূর্ত এবং কেইআইআইপি-র কর্তারা। পুরসভার নিকাশি দফতরের এক অফিসার জানান, সেখানেই জানা যায় ২০১২ সালের জুন মাসে কেইআইআইপি শহরের ম্যানহোল থেকে পলি তোলার জন্য ৩০টি মেশিন কেনে। এক-একটির দাম প্রায় ৮ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কেনা ওই সব মেশিন তিন বছর ধরে পড়েছিল।
ওই খবর প্রকাশ হতেই কেইআইআইপি-র বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত অনেকেই। পুরসভা সূত্রের খবর, শহরের নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়নে কেইআইআইপি-র বড় ভূমিকা রয়েছে। মূলত শহরে পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশির কাজ করে থাকে কলকাতা পুরসভারই এক সংস্থা কেইআইআইপি। স্বভাবতই ওই সংস্থার কোনও গাফিলতি থাকলে তা পুর-প্রশাসনের উপরেই বর্তায়। তা জেনেই এ দিন পুরসভার একাধিক মেয়র পারিষদ ওই বৈঠকে হাজির থাকা কেইআইআইপি-র অফিসারদের ভর্ৎসনা করেন। সেখানে উপস্থিত থাকলেও কেইআইআইপি-র ডিজি (প্রকল্প) চুপচাপই ছিলেন এবং পরেও এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
পুরসভার এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, ওই সংস্থার কাজে পুর-কমিশনার এতই অসন্তুষ্ট যে, বলে ফেলেন ইংরেজ আমলে যা কাজ হয়েছিল, এখন কেইআইআইপি-র হাতে পড়ে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওই সংস্থার গাফিলতির কথা তুলে এক মেয়র পারিষদ বলেন, পূর্ব এবং দক্ষিণ কলকাতা এলাকায় থাকা পাগলাডাঙা, পামারবাজার, চিংড়িঘাটা, তপসিয়া এবং ধাপা-চৌবাগা পাম্পিং স্টেশন দিয়ে ঘেরা থাকা সত্ত্বেও জল জমা থেকে শহরকে মুক্ত করতে পারেনি কেইআইআইপি। এর জন্য দায়ী মূলত সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থার অভাব বলেই মনে করা হচ্ছে। পাম্পিং স্টেশনে দক্ষ কর্মী থাকা নিয়েও এ দিন আলোচনা হয়েছে। পুরসভার নিকাশি দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, অধিকাংশ পাম্পিং স্টেশনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা অনেকেই কখন পাম্প চালাতে হবে, কখন বন্ধ করতে হবে, জানেন না। পাম্পিং স্টেশনে কত উচ্চতায়
জল উঠলে পাম্প চালাতে হয়, তা না জানায় জল জমতে থাকে শহরে। আইটিআই পাশ করা যুবকদের সেখানে কর্মরত করার কথাও আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে।
প্রতি বছর বর্ষার কয়েক মাস আগে থেকেই শহরকে জল জমার হাত থেকে রেহাই দিতে প্রাক প্রস্তুতি বৈঠক হয়। এ বারও হয়েছে। তবে কার্যক্ষেত্রে নিকাশি নালা পরিষ্কার রাখার জন্য ম্যানহোলের নীচ থেকে পলি তোলার কাজে ঢিলেমি রয়েই গিয়েছে। এ ব্যাপারে পুরসভার এক আমলা জানান, ম্যানহোল থেকে পলি তোলার জন্য এতগুলো মেশিন থাকা সত্ত্বেও কাজ হয়নি কেন, তার কারণ জানা হচ্ছে। আপাতত ওই মেশিন দিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে।
তবে শনিবার আবহাওয়া দফতর যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, তার জন্য পুরসভার নিকাশি দফতরের প্রতিটি এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, সহকারী ইঞ্জিনিয়ার-সহ সকলকে রাতভর পাম্পিং স্টেশনে হাজির থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুরসভার মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ এ দিন বলেন, ‘‘পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে শহরের ১৬টি বরো দেখভালের জন্য বিভিন্ন মেয়র পারিষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কন্ট্রোল রুমেও থাকব আমরা।’’ শহরে জল জমলেই তা সরাতে তৎপর থাকবে পুরকর্মীরা।
তারকবাবু জানান, দক্ষিণ কলকাতার ৩২টি ওয়ার্ড এলাকার নিকাশি খালের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়। পরে তা গিয়ে নদীতে পড়ে। এখন নদীর জল বেড়ে যাওয়ায় নিকাশির জল খাল দিয়ে নদীতে যেতে পারছে না। স্বভাবতই আরও বৃষ্টি হলে ওই সব এলাকায় জল জমার আশঙ্কা রয়েছে। তবে পরিস্থিতির দিকে সব সময়ে পুর-প্রশাসনের নজর রয়েছে বলেও জানান তিনি।