চা নিয়ে চাপানউতোরে’ মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) সুদীপ্তা চক্রবর্তী, ঋতাভরী চক্রবর্তী, ঊষসী চক্রবর্তী, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, চূর্ণি গঙ্গোপাধ্যায়, রূপম ইসলাম, চৈতী ঘোষাল এবং শ্রীজাত। রবিবার, জি ডি বিড়লা সভাগারে। — নিজস্ব চিত্র
বাঙালির বর্ণবিদ্বেষী দুর্নাম নেই। তবে চায়ের রঙে হয়তো আছে। চায়ের কাপে যেমন রাজনীতির বিতর্ক ঝড় তোলে, চায়ের রঙেও তেমনই ‘লাল-সবুজ’ বিভাজন রপ্ত করতে শিখে গিয়েছে বাঙালি। এটাই কবি শ্রীজাতর অভিজ্ঞতা।
রবি-সন্ধ্যায় চা নিয়ে এক বিতর্কসভায় তিনি শোনালেন সেই কথা। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের ফল বেরোনোর সন্ধ্যায় পাড়ার চায়ের দোকানে লাল চা চেয়ে নাকি শ্রীজাতকে শুনতে হয়েছিল, ‘‘লাল চা আর নেই। এখন থেকে সব গ্রিন টি।’’ সঙ্গে শ্রীজাতর সংযোজন, ‘‘এ বার বোধহয় চায়ের দোকানে স্যাফ্রন টিও রাখা শুরু হয়েছে।’’
চায়ের রং নিয়ে এমনই নানা যুক্তির চাপান-উতোর চলল মাদার ডেয়ারি ‘ডেলিশিয়াস’ এবং আনন্দবাজার পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ দিন সন্ধ্যার বৈঠকে। বিতর্কসভার বিষয় ছিল, বদলে যাওয়া চায়ের রঙের সঙ্গে বদলেছে বাঙালির মনন।
আসলে চা যেমন বাঙালির মননের শরিক, তেমনই শরিক তর্কও। চা আর তর্কে বরাবরই মিলেমিশে একাকার বাঙালি। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও সেই তর্ক ছিল। যার এক দিকে ছিলেন চা ব্যবসায়ীরা এবং বিপক্ষে বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এ দিন সেই দায়ভার নিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের তারকারা।
দুধ চা ভাল নাকি লিকার, এ নিয়ে তর্কের অন্ত নেই। নবপ্রজন্মের চায়ে তো দুধ-চিনির ‘ক্যালোরিবর্ধক’ দ্রব্য একদমই না-পসন্দ। এই প্রশ্ন তুলেই বিতর্কসভার পক্ষে ইনিংস শুরু করলেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, এ যেন এক বাটি ছানা দিয়ে হুইস্কি খাওয়া!
হুইস্কির প্রসঙ্গ যদি আসে, তা হলে চা তার বিপরীত দিকেই থাকবে। পুরনো আমলের সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বলছে, চায়ের প্রচার বাড়াতে মাদকতাহীনতাকেও সে আমলে হাতিয়ার করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তাতে বলা হতো, ‘‘যাহাতে নাহিক মাদকতা দোষ, কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতোষ।’’ এই চিত্ত পরিতোষের অঙ্গ হিসেবেই গড়ে উঠেছিল রাধুবাবুর দোকান, বলবন্ত সিংহের ধাবার মতো চায়ের ঠেক। সেই সব চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েই বাঙালি তর্ক জুড়ত, প্রতিবাদের ভাষা গড়ে উঠত। এ দিনের বিতর্কসভার বিপক্ষের বক্তা অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালের বাড়ি রাধুবাবুর দোকানের উপরেই। আজও চায়ের দোকানে তর্কের শব্দে ঘুম ভাঙে তাঁর। চৈতির দলের শরিক গায়ক রূপম ইসলাম আবার টেনে আনলেন ব্যক্তিগত পছন্দকে। দুধ চা দিয়ে শুরু করলেও আজ লাল চায়ে মজেছেন রূপম। তাঁর মতে, ব্যক্তিভেদে চায়ের রং বদলাতেই পারে, তার প্রভাব বাঙালি মননের শরিক নয়।
হাওড়া থেকে বারুইপুর, বিভিন্ন দোকানে চা খেয়ে বেড়ানো শ্রীজাতর অভিজ্ঞতা, বাঙালির চায়ের রং বদলায়নি। বদলায়নি মননও। বরং চায়ের সঙ্গে রাজনীতির রং নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাই সেই মননের অঙ্গ।
বিপক্ষের যুক্তি অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন পক্ষের বক্তা অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তী আর ঋতাভরী চক্রবর্তী। চায়ের সঙ্গে বাঙালির প্রতিবাদ, শিল্প-সাহিত্যের মান পড়ে যাওয়াকে টেনে এনেছেন তাঁরা। বাঙালি এখনও দুধ, চিনি মিশিয়ে তরিবত করে চা খায়, তা বোঝাতে গিয়ে অভিনেত্রী চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘বাঙালি চা রান্না করে।’ আর এক অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী তাঁকে বিঁধলেন, বাঙালির রান্নার সময় কোথায়? এখন তো সবই চটপট ব্যাপার।
তবে জিতল কে? শুরুতেই সঞ্চালক গায়ক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি ‘মধ্যপন্থী’। শেষে বললেন, এই তর্কে উঠে এল না বাঙালির যৌথতার কথা। তবুও সভার মত নিয়ে জয়ী-বিজয়ী ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। শ্রোতারা হাত তুলতে বোঝা গেল, বাঙালি এ বিষয়েও মধ্যপন্থী।
আমবাঙালির মতে, লাল চা থাক। তবু মাঝেমধ্যে সেই চায়েই যেন পড়ে কয়েক চামচ দুধও!