যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায় (বাঁ দিকে)। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ (ডান দিকে)। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের (স্নাতক) ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবারও দিনভর উত্তপ্ত রইল ক্যাম্পাস। ছাত্রমৃত্যুর প্রতিবাদে বিজেপির যুব মোর্চার অবস্থান বিক্ষোভে বৃহস্পতিবার উপস্থিত হয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সেই সময় তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয় বলে অভিযোগ। শুভেন্দু বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ছাত্র সংগঠন রেভলিউশনারি স্টুডেন্টস ফ্রন্ট (আরএসএফ) এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। তাতে দু’পক্ষের বেশ কয়েক জন আহত হন। ছাত্রমৃত্যুর বিচার চেয়ে বৃহস্পতিবারও ক্যাম্পাসের বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন অনেক পড়ুয়া। অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিলেন নদিয়া থেকে কলকাতায় পড়তে আসা ওই ছাত্র। অভিযোগ, তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যে র্যাগিংই দায়ী। এর পর থেকেই র্যাগিং-বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল যাদবপুর। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়কে লালবাজারে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, ডিন জানিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের বাধাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও ‘নিয়মকানুন’ প্রয়োগ করা যায় না।
যাদবপুরের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মোট ন’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা সৌরভ চৌধুরী, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি থানা এলাকার বাসিন্দা অসিত সর্দার, মন্দিরবাজারের সুমন নস্কর এবং পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বাসিন্দা সপ্তক কামিল্যা। এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পড়ুয়াদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে জম্মুর বাসিন্দা মহম্মদ আরিফ (তৃতীয় বর্ষ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), পশ্চিম বর্ধমানের বাসিন্দা আসিফ আফজল আনসারি (চতুর্থ বর্ষ, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা অঙ্কন সরকার (তৃতীয় বর্ষ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), মনোতোষ ঘোষ (দ্বিতীয় বর্ষ, অর্থনীতি) এবং দীপশেখর দত্তকে (দ্বিতীয় বর্ষ, সমাজবিদ্যা)। এঁদের অনেকেই ঘটনার পর হস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ওই দিন ঘটনাস্থলে ১০-এর বেশি পড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন। আরও কয়েক জন পড়ুয়া তদন্তকারীদের নজরে রয়েছেন।
যাদবপুরের ঘটনায় ধৃত কাশ্মীরি ছাত্র মহম্মদ আরিফের দাদা বৃহস্পতিবার কলকাতায় এসেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে তিনি কথাও বলেন। বৃহস্পতিবার পুলিশের কাছে নিজের বয়ান জানিয়েছেন এক ট্যাক্সিচালক। ঘটনার রাতে তাঁর ট্যাক্সিতেই স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মৃতপ্রায় ওই ছাত্রকে।
নজরে আরও পড়ুয়া
যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় হস্টেলের আরও কয়েক জন আবাসিক পুলিশের নজরে রয়েছেন। তাঁদের পরিচয় প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তবে পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার দিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই পড়ুয়ারাও। এখনও পর্যন্ত এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ন’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই ছাত্রের মৃত্যুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অন্য পড়ুয়াদের যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাঁদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। ঘটনাস্থলে ১০ জনের বেশি উপস্থিত ছিলেন বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
‘ভাই কী করেছে জানি না’
যাদবপুরের ঘটনায় ধৃত কাশ্মীরি ছাত্র মহম্মদ আরিফের দাদা বৃহস্পতিবার কলকাতায় এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর ভাই কী করেছেন, কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হল, এখনও কিছুই জানেন না তাঁরা। গ্রেফতারি তো দূরের কথা, ভাই যে কোনও অপরাধ করতে পারে, তা-ও বিশ্বাস হয় না দাদার। আরিফের এক জেঠতুতো দাদাও পুলিশের ফোন পেয়ে কলকাতায় এসেছেন। পুলিশের কাছে গিয়ে তাঁরা এফআইআরের কপি চেয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ, ওই কপি তাঁদের কোর্ট থেকে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় ডায়েরি উদ্ধার
হস্টেলে নদিয়ার ওই ছাত্র যে ঘরে থাকতেন, সেখান থেকে আগেই একটি ডায়েরি উদ্ধারের কথা জানা গিয়েছিল। পরে জানা যায়, হস্টেলে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ আরও একটি ডায়েরি পেয়েছে। গত ১২ অগস্ট সেটি উদ্ধার করা হয়েছে চার তলার ১০৪ নম্বর ঘর থেকে। ওই ঘরে থাকেন ধৃত পড়ুয়া মনোতোষ ঘোষ। ডায়েরিটিকে ঘিরে নতুন রহস্য দানা বেঁধেছে। কারণ, সেখানেও একটি চিঠি মিলেছে। ডায়েরির ১৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় ডিন অফ স্টুডেন্টসের উদ্দেশে লেখা ওই চিঠিতে রয়েছে ১০ অগস্টের তারিখ। ধৃত পড়ুয়া দীপশেখর দত্ত দাবি করেছিলেন, মৃত ছাত্রের হয়ে তিনি এই চিঠি লিখেছেন।
সইয়ের পর সই
হস্টেল থেকে উদ্ধার হওয়া ওই দ্বিতীয় ডায়েরিতে চিঠি ছাড়া আরও একটি সন্দেহজনক পৃষ্ঠা রয়েছে। ১৯৯ নম্বর পৃষ্ঠায় অনেকগুলি স্বাক্ষর পেয়েছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রে খবর, সেই স্বাক্ষর মৃত ছাত্রের নামেই। প্রাথমিক ভাবে দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন সেই স্বাক্ষরের অনুশীলন চালিয়েছেন। এখানে রহস্য, কেউ কি ছাত্রের স্বাক্ষর নকল করার চেষ্টা করেছিলেন ডায়েরিতে? খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
হস্টেল সুপারের বক্তব্য
যাদবপুরের হস্টেলের এক সুপার জানিয়েছেন, র্যাগিংয়ের কথা তিনি জানতেন। নতুন ছেলেরা হস্টেলে এলে সিনিয়রেরা যে ‘ইন্ট্রো’ নিতেন, তা-ও তাঁর জানা ছিল। কিন্তু তার ফলে যে কারও মৃত্যু ঘটতে পারে, ধারণা করতে পারেননি তিনি। ওই সুপারের দাবি, হস্টেলে সিনিয়রদের প্রভাব ছিল। কর্তৃপক্ষও র্যাগিংয়ের কথা জানতেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাঁর আরও দাবি, রাতে কোনও গোলমাল হলে কোনও দিনই কর্তৃপক্ষকে পাশে পাননি সুপারেরা। দু’জন সুপার হস্টেলের ৬০০ পড়ুয়ার সঙ্গে পেরে উঠবেন না ভেবেই চুপ থাকতে হয়েছে তাঁদেরও। সুপার জানিয়েছেন, শুধু র্যাগিং নয়, হস্টেলে নেশার আসরও বসত। মদ, গাঁজা সবই সেবন করা হত। কখনও ঘরের মধ্যে, কখনও ছাদে উঠে নেশা করতেন পড়ুয়ারা। সেখানে সুপারদের নজরদারি কেউ পছন্দ করতেন না।
যাদবপুরে ধুন্ধুমার
যাদবপুরের ঘটনার প্রতিবাদে বিজেপির যুব মোর্চার অবস্থান বিক্ষোভে হাজির হয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয় ছাত্র সংগঠন আরএসএফের তরফে। শুভেন্দু বেরিয়ে যাওয়ার পরেই এবিভিপির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আরএসএফ। তাদের অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় হামলা চালানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেটের সামনে হুলস্থুল বেধে যায়। দু’পক্ষের মারামারিতে জখম হন বেশ কয়েক জন। এক যুবকের নাক, মুখ ফেটে রক্ত পড়তে দেখা গিয়েছে। আহত হয়েছেন এক রূপান্তরকামীও। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
কী বললেন শুভেন্দু
বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর গেটের সামনে এবিভিপির অবস্থান বিক্ষোভ চলছিল। সেখানে শুভেন্দু যোগ দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শুভেন্দু ওই মঞ্চ থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন, ১৫ জন বিজেপি বিধায়ককে নিয়ে শুক্রবার তিনি নদিয়ার বগুলায় মৃত ছাত্রের বাড়িতে যাবেন। তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন। এর আগে সেখানে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল গিয়েছিল। ওই দলে ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও। যাদবপুর থেকে শুভেন্দু ব্রাত্যকে নিশানা করে বলেছেন, ‘‘বিধানসভায় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে হিসাব বুঝে নেব। শিক্ষামন্ত্রী, আপনি পালিয়ে যাবেন না!’’ পড়ুয়ার বাবা, মায়ের অনুমতি পেলে এই ঘটনার আইনি লড়াইয়ের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেবেন বলে জানিয়েছেন শুভেন্দু।
কী বললেন ট্যাক্সিচালক
যে হলুদ ট্যাক্সিতে চাপিয়ে গত বুধবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃতপ্রায় ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার চালককে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করল পুলিশ। তাঁকে যাদবপুর থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, সেই রাতে প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রকে নিয়ে কারা হাসপাতালে গিয়েছিলেন, তা তিনি জানিয়েছেন। সূত্রের খবর, সেই ট্যাক্সিচালক বৃহস্পতিবার পুলিশকে জানিয়েছেন, আহত ওই ছাত্রের সঙ্গে আরও কয়েক জন ছাত্র ছিল। তাঁদের ওই বেসরকারি হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।