বাবুঘাটে পুণ্যার্থীদের গাড়িতে বসানো রয়েছে জেনারেটর। ছবি: রণজিৎ নন্দী
গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীরা এমনই নেশাগ্রস্ত যে, প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলন্ত গাড়িতে বসে থেকেও তাঁরা কেউ বুঝলেন না যে, সঙ্গীরা মারা গিয়েছেন! গাড়ি থামাতে বলা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দূর অস্ত্! পরে পুলিশ গাড়ি থামালে তাঁদের অবাক করা উত্তর, ‘‘মনে হয়েছিল, নেশা হয়ে গিয়েছে, তাই হয়তো নড়ছে না!’’
বৃষ্টি মাথায় করে জলপাইগুড়ির জল্পেশ মন্দিরে জল ঢালতে যাওয়ার পথে ভ্যানে ১০ পুণ্যার্থীর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় এমনই তথ্য সামনে আসছে। মেখলিগঞ্জের কাছে ওই ঘটনা রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে নানা মহলে। কারণ, গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে ওই গাড়িতেই তোলা হয়েছিল তিনটি বিশালায়তনের ডিজে বক্স এবং ডিজ়েলচালিত জেনারেটর। চালকের কেবিনের ছাদের উপরে রাখা ছিল গান বাজানোর যন্ত্র! পুলিশের দাবি, বৃষ্টির জল পড়ে সেটিই হয়ে উঠেছিল তড়িৎবাহিত। যদিও এমন পুণ্য-যাত্রায় জেলা জুড়ে এমন নেশার বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে বক্স বাজানোর রমরমা চলতেই থাকে বলে অভিযোগ। তাতে না থাকে পুলিশি ধরপাকড়, না থাকে গাড়ি থামিয়ে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ। ব্যতিক্রম নয় কলকাতাও।
শ্রাবণ মাসে কলকাতা থেকেও তারকেশ্বরে যেতে বহু পাড়া থেকে এমন ছোট ভ্যান বা লরির ব্যবস্থা করা হয়। ছোট ছোট গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে তারকেশ্বর পৌঁছনোর উদ্যোগও কিছু কম নেই। লরি বা ভ্যানের মাথায় বিশাল বিশাল বক্স চাপিয়ে মেখলিগঞ্জের মতোই ডিজের ব্যবস্থা থাকে। অভিযোগ, বক্স বাজানোর জন্য তোলা হয় জেনারেটর এবং ডিজ়েল। খরচ বাঁচাতে কাটা তেল ব্যবহারের অভিযোগও প্রচুর। বৃষ্টি এলে কী হবে, সে নিয়ে প্রায় কোনও ভাবনাচিন্তাই নেই।
নিয়ম মেনে এমন জেনারেটর চালাতে ‘আর্থিং’ করার প্রয়োজন। অর্থাৎ, একটি তারের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে মাটির সংযোগ রাখতে হবে। কিন্তু গাড়িতে তা সম্ভব নয়। সেই ব্যবস্থাও নেই। হিসাব নেই জেনারেটর থেকে বেরিয়ে থাকা তারেরও। সেগুলিতে সামান্য কালো টেপ মারাও থাকে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাইরে একটি কাঠ বা বিদ্যুতের সুপরিবাহী নয়, এমন কোনও জিনিসের উপরে জেনারেটর বসানোর কথা। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য জেনারেটরের উপরে ত্রিপল টাঙাতে হয়। তা হলে ‘শর্ট সার্কিট’ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু ভাবনাচিন্তা নেই এ সব নিয়েও।
ত্রিপল অবশ্য ব্যবহার করা হয় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে। অভিযোগ, কাপড় বা কালো প্লাস্টিকে ঢেকে জেনারেটর এবং ডিজে বক্স নিয়ে শহরের বাইরে বেরোতে পারলেই হল! শহরতলির রাস্তায় পড়েই শুরু হয় বক্স বাজিয়ে দেদার নাচ! তার সঙ্গে চলতে থাকে যেমন খুশি নেশা।ওই অবস্থায় কেউ এক সময়ে উঠে পড়েন লরি বা ভ্যানচালকের কেবিনের মাথায়, কেউ ঝুলতে থাকেন লরির গায়ের লোহার রড ধরে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের আশপাশ নিয়ে হুঁশ থাকে না। কেউ ওভারহেড তারে ধাক্কা খেয়ে নীচে পড়েন। রাস্তার হাইট বারে ধাক্কা খায় কারও মাথা। একাধিক ক্ষেত্রে আবার দু’টি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কখনও পথচলতি পুণ্যার্থীদের পিষে দিয়ে যায় পুণ্যার্থীদেরই গাড়ি।
গত সোমবার তারকেশ্বর থেকে ঘুরে আসা উত্তর কলকাতার গৌরীবাড়ি এলাকার এক যুবক বললেন, ‘‘এতটা রাস্তা, গানবাজনা না থাকলে হয়! জল ঢালতে গেলে গান, নেশার জিনিস লাগে। সব রকম ব্যবস্থা থাকলে কষ্টটা আর কষ্ট বলে মনে হয় না।’’ গিরিশ পার্ক এলাকায় আবার বাঁক নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত কয়েক জনের বিরুদ্ধে তারস্বরে গান বাজানোর অভিযোগ উঠছে কয়েক দিন ধরেই। তাঁদের এক জনের দাবি, ‘‘আর তো ক’টা দিন। সামনের রবিবারই বেরোব। গাড়িতে এই বক্সগুলো তুলে নেব। পাড়ার লোকের আর ঝঞ্ঝাট থাকবে না।’’ স্থানীয় থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের উত্তর, ‘‘বক্স জোরে না বাজাতে বলা হয়েছে। এই সব বিষয়ে উপরতলা থেকে বুঝিয়েসুঝিয়ে কার্যোদ্ধার করতে বলা হয়েছে।’’
এই ভাবে কার্যোদ্ধার করতেই কি পুণ্যার্থীদের ডিজে গাড়ি ধরা হয় না? রাজ্য পুলিশের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘মেখলিগঞ্জের ঘটনার পরে মানুষের মধ্যেও ভয় ঢুকেছে। ওই রকম গাড়ি এ দিন রাস্তায় অনেক কম। কিন্তু ১৫ অগস্ট শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার। সেই দিনই ভিড় সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা। তার আগে বিশেষ কড়াকড়ি করা হবে।’’ কিন্তু তার মধ্যেই ফের কিছু ঘটে গেলে? স্পষ্ট উত্তর নেই কোনও মহলেই।