ইয়াস আছড়ে পড়ার আগে শহরে চলছে গাছের ডালপালা ছাঁটার কাজ। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র।
লকডাউনের মতো আরও একটি কঠিন সময় এবং সামনে আবার একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রায় চেনা প্রশ্নপত্র। তবু যেন উদ্বেগ কাটছে না।
সেই উদ্বেগেই ঘরবন্দি শহরবাসীর মনে ঘুরেফিরে আসছে প্রশ্নগুলি— ‘ইয়াসের’ শক্তি কেমন? আমপানের থেকে কম তো? কলকাতায় যদি আসে, গতি কত হবে? আমপানের চেয়ে কম নিশ্চয়ই? মঙ্গলবারই আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, কলকাতায় তেমন ভাবে ঝড়ের প্রভাব পড়বে না। তা সত্ত্বেও দিনভর পুরনোর সঙ্গে এই তুলনা কি এক বছর আগে ঝড়ের পরীক্ষায় পাশ করে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা মনে করে মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা?
সচেতন নাগরিক থেকে মনোরোগ চিকিৎসকদের বড় অংশই বলছেন, এটা আসলে এক বার পারলে আরও এক বার পারার মানসিক শক্তি সঞ্চয়। গত বছরের অভিজ্ঞতা অনেকের মনে শুধু যে যুদ্ধ জয়ের সাহস জোগাচ্ছে তা-ই নয়, তৈরি করছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে রাখার দায়িত্ববোধও।
শ্যামবাজারের মালতী বর্মণ যেমন জানালেন, আমপানে তাঁদের ঘরের টালির চাল উড়ে গিয়েছিল। প্রায় পনেরো দিন মাথার উপরে প্লাস্টিক টাঙিয়ে কাটিয়েছিলেন। টালি উড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পাশের একটি বাড়িও। এ বার সতর্ক হয়ে গত দু’দিন ধরে নড়বড়ে টালি সরিয়েছেন মালতীদেবীরা। তিনি বললেন, ‘‘এর পরে যা আছে দেখা যাবে, অন্তত নিজেরা তো তৈরি থাকলাম।’’ গিরিশ পার্ক এলাকার বাসিন্দা, স্কুলশিক্ষিকা সুলগ্না বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, গত বছরের টানা বিদ্যুৎহীন অবস্থার কথা মনে রেখে চার দিনের জন্য ভাড়ায় একটি জেনারেটর আনিয়ে রেখেছেন। করোনা আক্রান্ত বাবা-মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ তুলে রাখার পাশাপাশি হাতের কাছেই রেখেছেন চিকিৎসকদের ফোন নম্বর। তাঁর কথায়, ‘‘তবু উদ্বেগ যাচ্ছে না। ঝড়ের মধ্যেই কারও শরীর খারাপ হলে কী করে সামাল দেব, সেটাই ভাবছি।’’
যাদবপুরের বাসিন্দা সুনয়না ঘোষ আবার জানালেন, উদ্বেগের সমস্যা নিয়ে তাঁকে প্রায়ই মনোরোগ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হয়। ঝড়-বৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হলে যা আরও বাড়ে। গত কয়েক দিন ধরে ইয়াস নিয়েই ব্যস্ত, বছর ৫৪-র সুনয়না বলেন, ‘‘ঝড়টা ঠিক কোথায় রয়েছে, সে দিকেই এখন আমার নজর। অনেকেই অনেক রকম ভুয়ো খবর
ছড়াচ্ছেন। কিন্তু আমার চিকিৎসক সে সবে কান না দিয়ে শান্ত থাকতে বলছেন। তিনিই জানালেন, কলকাতায় তেমন প্রভাব পড়বে না।’’ সন্ধ্যার পরে এই খবর শুনে গড়িয়াহাটের সুমন প্রামাণিক বললেন, ‘‘আগের বারের ধ্বংসলীলা সামনে থেকে দেখেছি। উদ্বেগের এই কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলেই হল।’’
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) শুভঙ্কর সিংহ সরকার বলেন, ‘‘ঝড়ের প্রভাব যা-ই পড়ুক, সব রকমের বন্দোবস্ত রাখা হচ্ছে। পুরসভা, বিদ্যুৎ সংস্থা এবং পুলিশের মধ্যে একশো শতাংশ সমন্বয় নিশ্চিত করতে লালবাজারে বিশেষ কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সকলের কাছে অনুরোধ, ঝড় নিয়ে ভুল তথ্য আর গুজব ছড়াবেন না। নিশ্চিত না হয়ে কোনও তথ্য বিশ্বাসও করবেন না।’’ মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘এ বার সাধারণ নাগরিকেরা অনেক বেশি প্রস্তুত, অনেক বেশি সচেতন। ফলে ভয় অনেক কম। ভুল তথ্য না ছড়িয়ে যাঁরা মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে আছেন, তাঁদের সাহস দিন।’’
মধ্য কলকাতার একটি দমকলকেন্দ্রের এক কর্মী আবার বললেন, ‘‘এত উদ্বেগের কী আছে? করোনার সঙ্গে লড়ছে যে শহর, তার কাছে এই ঝড় আর এমন কী ব্যাপার!’’