মেঘ জমেছে: আজ, বুধবার আছড়ে পড়ার কথা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের। তার আগে, মঙ্গলবার শহরের আকাশ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
‘‘আমপানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বুঝতেই আমাদের প্রায় সাত মাস লেগেছিল। তার পরেও টুকটাক মেরামতির কাজ হয়েছে। ইয়াসের ক্ষেত্রে কী হবে, কে জানে!’’ উদ্বেগের সুরে কথাগুলো বলছিলেন পুরকর্তা।
সাত মাস!— মানে গত বছরের মে মাসের আমপান বিপর্যয়ের পরে ডিসেম্বর পর্যন্ত কলকাতা পুরসভা যত দরপত্র-বার্তা (টেন্ডার-বার্তা) ডেকেছিল, সেখানে কোথাও না কোথাও ওই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে মেরামতির কথা বলা হয়েছিল। পুরসভার তথ্য বলছে, গত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৬১টি দরপত্র-বার্তা ডাকা হয়েছিল। তার প্রায় সব ক’টিতেই উল্লেখ ছিল আমপানে ক্ষয়ক্ষতির মেরামতিতে প্রস্তাবিত খরচের হিসেব। প্রসঙ্গত, এই ধরনের বিপর্যয় সামলানোর জন্য পুরসভার ‘ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’ নামে নিজস্ব একটি ফান্ড রয়েছে। তবে পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, সাধারণত এ ধরনের বিপর্যয়ে রাজ্য সরকারের তরফেও আর্থিক অনুদান পাওয়া যায়।
তা আমপানে পুরসভার ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ কত ছিল?
পুরসভার সেই সব দরপত্র-বার্তার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘গত জুনে পুরসভার দরপত্র-বার্তা আক্ষরিক অর্থেই আমপান-বার্তা হয়ে উঠেছিল।’’ তথ্য অনুযায়ী, আমপানের ক্ষতি সামাল দিতে সেই মাসে প্রস্তাবিত খরচের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৭ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা। যার সিংহভাগই ছিল উপড়ানো বাতিস্তম্ভ মেরামতির খরচ। ১-১৬ নম্বর বরোর অধীনস্থ ৯০টিরও বেশি ওয়ার্ডে তাণ্ডব চালিয়েছিল আমপান।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, ইয়াসও কি সেই বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি করবে?
আবহবিজ্ঞানীদের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, আমপানের সময়ে বিদ্যুতের খুঁটি, গাছ উপড়ে শুধু কলকাতা কেন, হুগলি, নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা-সহ একাধিক জেলা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। তবে ইয়াসের ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কা কম। এক আবহবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘কলকাতায় সাধারণ ঝড়ের পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে।’’ ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিরিয়োলজি’র ‘মনসুন মিশন’-এর সিনিয়র বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় আবার জানাচ্ছেন, রাজ্য সরকার আমপানের সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে দেরি করায় পরিস্থিতি জটিল হয়। তাঁর কথায়, ‘‘ইয়াসের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময় হাতে রেখেই রাজ্য প্রশাসন প্রস্তুতি নিয়েছে।’’
‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস’-এর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়ের অধ্যাপক অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, কোনও এলাকার ‘ভালনারেবিলিটি’ ওই এলাকার ‘এক্সপোজ়ার’, সেখানকার ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ এবং কোনও বিপর্যয় সংশ্লিষ্ট এলাকা কতটা দ্রুত সামাল দিয়ে উঠতে পারবে, মূলত এই তিনটি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। যার মাধ্যমে এলাকা কতটা বিপর্যয়প্রবণ, তার সূচক বার করা সম্ভব। যা আগাম ক্ষতি রুখতে সাহায্য করে। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে পরিকাঠামোগত ক্ষতি এড়াতে যে উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবেশ খাতে যতটা বিনিয়োগ দরকার, তা এ দেশে নেই। তবে অপরাজিতার কথায়, ‘‘প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে ঠিক সময়ে জনসাধারণকে সচেতন করলে এবং তাঁদের অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করলে প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব। যেটা ওড়িশা নিয়মিত ভাবে করে আসছে।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভিজ়িটিং ফ্যাকাল্টি বিশ্বজিৎ সোমের আবার বক্তব্য, বৃষ্টির পূর্বাভাস অনুযায়ী শহরের চুন-সুরকি নির্মিত বাড়িগুলির ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাঁর কথায়, ‘‘এক দমকায় প্রবল বৃষ্টি হলে ততটা ক্ষতি হয় না। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি হলে চুন-সুরকির বাড়ির উপরে অসম্ভব প্রভাব পড়ে। তখন যে কোনও মুহূর্তে দেওয়াল, ছাদ ধসে যেতে পারে।’’
এক পুরকর্তা বলছিলেন, গত বছরের ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছিল, শুধু বাতিস্তম্ভ, গাছ উপড়ে পড়াই নয়, ফুটপাতের পেভার ব্লক, শহর জুড়ে গ্লো সাইন বোর্ড, বিভিন্ন এলাকার বাসস্ট্যান্ড, পুরসভার গ্যারাজ, অফিস-সহ অজস্র জায়গায় আমপান ধ্বংসচিহ্ন ছেড়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিপর্যয়ের সময়ে বোঝা যায় না, তার মাত্রাটা ঠিক কত। বোঝা যায়, তা থামলে!’’
আমপান থামলেও সেই ক্ষত শহরকে বয়ে চলতে হয়েছে বহু মাস। ইয়াসে যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়, এটাই প্রার্থনা শহরের!