মগ্ন: শব্দছক তৈরিতে ব্যস্ত শুভজ্যোতি রায়। নিজস্ব চিত্র
শব্দই তাঁর ঘরবাড়ি! শব্দই তাঁর চাষবাস!
দিনে-রাতে শব্দ ভাঙাগড়া ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়েই তেমন সাড়াশব্দ নেই সন্তোষপুরের শুভজ্যোতি রায়ের। অন্তত তাঁর আত্মীয়-পরিজনের তেমনই দাবি।
স্কুলে পড়ার সময় পিছনের বেঞ্চে বসে লুকিয়ে শব্দছক করার জন্য ক্লাস থেকে সটান বাইরে বার করে দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক বাবা। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে উল্টে জেদ এমনই বাড়ে যে শব্দছক তৈরিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বছর ছত্রিশের শুভজ্যোতি।
১৯৯৭ সালে স্কুলে পড়ার সময় শুভজ্যোতির তৈরি করা শব্দছক প্রকাশিত হয়েছিল একটি দৈনিক পত্রিকায়। তার পর থেকে দৈনিক, পাক্ষিক, মাসিক, মিলিয়ে নানা ধরনের পত্রিকায় তাঁর তৈরি ১৭০০-এর বেশি শব্দছক প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য শব্দছক বানানোই তাঁর বর্তমান পেশা।
বাংলায় সাধারণ শব্দছক তৈরি ছাড়াও নানারকম বিষয়ভিত্তিক শব্দছকও তৈরি করেন শুভজ্যোতি। বাংলা নববর্ষ, ডাইনোসর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রথযাত্রা, ভূত, দুর্গাপুজো, বড়দিন থেকে কলকাতা শহর— প্রায় কিছুই বাদ নেই শুভজ্যোতির শব্দছকের বিষয় হওয়া থেকে।
সে জন্য তাঁর প্রস্তুতিও বড় কম নয়। বাড়িতে থরে থরে সাজানো নানা বাংলা অভিধান। এ পার বাংলা ছাড়াও ও পার বাংলার অভিধানও আছে সেই তালিকায়। সে সব ঘেঁটে শব্দের সালতামামি জানতে জানতেই দিন পেরিয়ে যায় তাঁর। কোথায় কী শব্দ রয়েছে সবই শুভজ্যোতির নখদর্পণে।
বন্ধু-বান্ধব খুব বেশি নেই। আড্ডায় যোগ দিলেও সেখানেও মাথার মধ্যে পাক খায় নতুন শব্দের খোঁজ। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আগ্রহও খুব সীমাবদ্ধ। টুইটারে আগ্রহ থাকলেও ফেসবুক নিয়ে প্রবল অনীহা রয়েছে।
মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের পরে পড়াশোনা বেশি এগোয়নি বলে বাড়িতে গঞ্জনা কম শুনতে হয়নি শুভজ্যোতিকে। তাঁর বাবা ভজহরি রায় যাদবপুরের পোদ্দার নগর বয়েজ স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সহ-প্রধান শিক্ষক। তিনি নিজেও বাংলার শিক্ষক ছিলেন। শুভজ্যোতির দিদি শর্মিষ্ঠা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তরের পরে গবেষণা করেছেন। আত্মীয়, পরিবার-পরিজনদের তুলনায় সে সব প্রসঙ্গ যত বেশি উঠেছে ততই জেদ বেড়েছে তাঁর।
সম্প্রতি বাংলায় বিপুল সংখ্যক শব্দছক প্রকাশিত হওয়ার জন্য সর্বভারতীয় স্বীকৃতি জুটেছে তাঁর ঝুলিতে। এর পরে বাংলায় শব্দছক নিয়ে অ্যাপ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে একটি নামী প্রযোজনা সংস্থা। শাড়ীর ফ্যাশন শো-তে শব্দছকের প্রিন্ট ব্যবহারের প্রস্তাবও দিয়েছে দু’-একটি সংস্থা। তবে সে সব নিয়ে খুব বিচলিত নন শুভজ্যোতি। তাঁর কথায়, “বাড়িতে গঞ্জনাটা কমেছে এই যা। পড়াশোনা না করে চাকরির পরীক্ষা না দিয়ে শুধু শব্দছক করা কোন বাড়িই বা মেনে নিতে পারে।”
কী ভাবে কাটে তাঁর দিন রাত?
ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশের পরেই চোখ বুলিয়ে নেন সংবাদপত্রে। এক ঝলক টিভির খবরের শিরোনাম দেখে নিয়েই বসে যান শব্দছক তৈরিতে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২ পর্যন্ত টানা চলে শব্দছক তৈরি। আগের রাতে তৈরি করা শব্দছক পাঠাতে থাকেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার দফতরে। দুপুরে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়েই ফের শুরু কাজ। টানা রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করে ঘণ্টা দু’য়েক ঘোরাঘুরি। রাতে আবার ঘণ্টাখানেক। দিনে ১২-১৫টি শব্দছক তৈরি করা তাঁর অভ্যেস।
এ ভাবে পারা যায়? তাঁর জবাব, “এটা আমারই বেছে নেওয়া। তাই পারা শুধু নয়, অনেক দূর যেতে চাই। অবসরে বায়োপিক ছবি দেখি। ফের প্রস্তুত হই। এটাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাই। ”
তাঁর বাবা ভজহরি এবং মা সুষমা এখন সব কিছুই মেনে নিয়েছেন। ওঁরা বলছেন, “ছেলে যাতে ভাল থাকে তাই সই। ও এটা নিয়েই ভাল আছে দেখি।”