আইন রয়েছে। আইনের প্রয়োগও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, তা সত্ত্বেও দক্ষ আইনজীবীর অভাবে একের পর এক মামলায় ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্তেরা। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মামলায় এ ভাবে অভিযুক্তেরা ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় খোদ সরকার অভিজ্ঞ আইনজীবীর তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে বলে সূত্রের খবর।
প্রশাসন সূত্রে খবর, কোনও নাবালিকা বা নাবালককে শারীরিক নির্যাতন করলে প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্স (পক্সো) ধারায় মামলা রুজু হয়। অভিযুক্ত সাবালক হলে সেই মামলা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি এ রাজ্যের হাইকোর্ট এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে, জেলার সাব-ডিভিশন আদালতে এ ধরনের মামলা বিচার করা যাবে। আর তা করতে গিয়েই প্রকট হয়েছে আইনজীবীদের আইন ও ধারা সম্পর্কে অজ্ঞতার ছবিটি। যার ফলে একের পর এক স্পর্শকাতর মামলায় অভিযুক্তেরা জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ।
কয়েকটি মামলার কথাও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে অভিযুক্তেরা জামিন পাওয়ায় নাবালিকা ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যেমন, নিউ টাউনে বছর চারেকের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল এক যুবক। চার্জশিটও জমা পড়ে। কিন্তু তার পরেও জামিনে ছাড়া পায় সে। উদাহরণ আছে আরও। বছর তেরোর এক কিশোরীর মা ও সৎ বাবার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের ক্ষেত্রে ধৃতেরা আট মাস পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। অথচ নাবালক-নাবালিকাদের উপরে যৌন নির্যাতন জামিন-অযোগ্য অপরাধ। শুধু দ্রুত ছাড়া পাওয়াই নয়। অভিযোগ, আইনজীবীরা আক্রান্তকে এমন প্রশ্ন করছেন যাতে তাদের উপরে মানসিক চাপ কমার বদলে বাড়ছে। যার পিছনে খোদ সরকারি কৌঁসুলিরাই নিজেদের অজ্ঞতাকে দায়ী করছেন।
শিশু-নিগ্রহ দমনে জড়িত সরকারি কর্তাদের মতে, এই মামলায় সওয়াল করতে হলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয়। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলিদের একাংশই বলছেন, ‘‘আমাদের মধ্যে এই আইন সম্পর্কে অনেকেই দক্ষ নন। ফলে অভিযুক্তেরা সহজে জামিন পাচ্ছেন। সাজার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে নিগৃহীতা ন্যায্য বিচার পাবে না।’’
প্রায় একই কথা বলছেন কলকাতা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সদস্য বসুন্ধরা গোস্বামীও। তাঁর কথায়, ‘‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট এবং পক্সো সম্পর্কে অভিজ্ঞ আইনজীবী না হলে এ ধরনের মামলার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে লড়লে ন্যায্য বিচার পাওয়া সত্যিই সম্ভব নয়। মামলাও দীর্ঘায়িত হয়।’’
এ নিয়ে কী ভাবছে রাজ্য সরকার? আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক জানান, হাইকোর্টের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই দফতর থেকে জেলার সাব-ডিভিশন আদালতের আইনজীবীদের একটি প্যানেল তৈরি করে পাঠাতে বলা হয়েছে। এই প্যানেলে মহিলা এবং জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট জানা আইনজীবীদের নাম নথিভুক্ত করার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। তাঁরাই এ ধরনের মামলা লড়বেন। ফলে শুনানি চলাকালীন নাবালক বা নাবালিকার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত হবে বলেই দাবি করেছেন আইনমন্ত্রী।
এর সঙ্গেই রয়েছে আদালতের পরিকাঠামোর অভাব। সরকারি আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, নিম্ন আদালতগুলিতে নিগৃহীত নাবালক-নাবালিকাদের সাক্ষ্যগ্রহণের উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। সাধারণত এ ধরনের মামলায় নাবালিকা বা নাবালককে অভিযুক্তের সামনে দাঁড় করিয়ে সাক্ষ্য নেওয়া যায় না। মাঝখানে পর্দা ব্যবহার করার কথা, যাতে অভিযুক্ত বা বাইরের কেউ তাকে দেখতে না পায়। কিংবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মেয়েটির বয়ান রেকর্ড করতে হয়। পুরোটাই এমন ভাবে করতে হয়, যাতে শিশুটির উপরে মানসিক চাপ না পড়ে। কিন্তু আইনজীবীরা মানছেন, জেলা আদালতগুলিতে এমন ব্যবস্থাই নেই। ফলে সাক্ষ্য দিতে এসে নিগৃহীতা নাবালিকার পরিচয় সর্বসমক্ষে চলে আসছে। ফলে যে বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিশেষ এই জুভেনাইল আইন, তা-ই বিঘ্নিত হচ্ছে বলে মনে করছেন সরকারি কৌঁসুলিদের একাংশ।