Corona

বন্ধ সীমান্ত পার করতে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে লাইনে

দুপুর দেড়টার চড়া রোদেও ঘরে ফেরার আশায় জমি আঁকড়ে পড়ে সকলে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪১
Share:

দুপুর দেড়টার চড়া রোদেও ঘরে ফেরার আশায় জমি আঁকড়ে পড়ে সকলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরণি হয়ে লম্বা ভিড়টা ভাগ হয়ে গিয়েছে সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের দু’দিকে। দুপুর দেড়টার চড়া রোদেও ঘরে ফেরার আশায় জমি আঁকড়ে পড়ে সকলে। কেউ এসেছেন গত রাতেই, কেউ ভোরে। ৯ নম্বর যে বাড়ি ঘিরে এই ভিড়, সেই বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের মূল গেটের কাছে হুইলচেয়ারে ধুঁকছেন এক বৃদ্ধ। সামান্য ছায়ার ব্যবস্থা হয়েছে, এক মহিলা তাঁর মাথায় ছাতা ধরে থাকায়।

Advertisement

“গ্লাভস, টুপি পরিয়ে এনেছি। কিন্তু মাস্ক পরাব কী করে, বুঝতে পারিনি”, বললেন ওই মহিলা। বৃদ্ধের নাকে তখনও গোঁজা রাইলস টিউব দেখিয়ে বললেন, “ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশ সব ক’টা স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে শুনে কালই বাবাকে ছুটি করিয়ে নিয়ে এসেছি হাসপাতাল থেকে। ক্যানসারের রোগী। ওঁর চিকিৎসা করাতেই এসেছিলাম। বাবার এই অবস্থা দেখলে যদি ডেপুটি হাইকমিশন দেশে ফেরার অনুমতি দেয়! বাবাই ভরসা আমাদের।”

গত সোমবারই ভারত থেকে স্থলসীমান্ত দিয়ে যাত্রী চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ৯ মে পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে যে সমস্ত বাংলাদেশির ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, শুধু তাঁরাই বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন থেকে ‘নো-অবজেকশন’ শংসাপত্র নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন। সঙ্গে কোভিড নেগেটিভ রিপোর্টও আনতে হবে। তবে যাঁদের ভিসার মেয়াদ ফুরোচ্ছে, শুধু তাঁরাই নন, কলকাতায় আটকে থাকা, দেশে ফিরতে ইচ্ছুক সব বাংলাদেশিই ভিড় করছেন ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে। বেশির ভাগই আশাহত হয়ে কলকাতার আস্তানায় ফিরে কোনও মতে দিন গুজরানের পরিকল্পনা করছেন।

Advertisement

বাংলাদেশিদের এমনই আস্তানা রয়েছে ইএম বাইপাস লাগোয়া সোনালি পার্ক, শান্তি পার্কের মতো এলাকায়। যেন একখণ্ড বাংলাদেশ। কোনও হোটেলের গায়ে লেখা, ‘বাংলাদেশের ঘরের খাবার’। কোনও গেস্ট হাউসের গায়ে ফ্লেক্সে লেখা—‘বাংলাদেশের বাড়ির কথা মনে পড়বেই’। তেমনই একটি গেস্ট হাউসে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে আটকে একাধিক বাংলাদেশি পরিবার। ওই বাংলাদেশিদের এক জন শাহনওয়াজ আলি বললেন, “আমার আট বছরের ছেলের গলায় টিউমার। এখানকারই একটা হাসপাতালে দেখাচ্ছি। গত ২৬ তারিখ অস্ত্রোপচারের তারিখ মিলেছিল। এখন বলছে, কবে অস্ত্রোপচার হবে, বলা যাচ্ছে না। দেশেও ফিরতে পারছি না।” কিডনির সমস্যায় ভোগা স্ত্রীকে দেখিয়ে শাহিল ইসমাইল নামে এক ব্যক্তি বললেন, “তিন বার করোনার রিপোর্ট করিয়েও কিডনির অস্ত্রোপচার করাতে পারলাম না। যে হাসপাতালে দেখাচ্ছিলাম, সেটা পুরোটাই কোভিড হাসপাতাল হবে। আগামী ছ’মাস তারিখ মিলবে না। দেশেও ভাইয়ের পরিবারে দু’জনের করোনা। টাকা পাঠানোর অবস্থা নেই। সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা কিছু না করতে পারলে জানি না কী হবে!”

কয়েক পা এগিয়েই শান্তি গেস্ট হাউস। মালিক দেবব্রত ঘোষ দুপুর রোদে বিশ্রামে ব্যস্ত। স্পষ্ট বললেন, “ঘর নেই। একটি পরিবার আছে। নতুন কোনও বাংলাদেশিকে ঘর দিচ্ছি না। ওঁরা কবে দেশে ফিরতে পারবেন, জানেন না। ভাড়ার টাকাও দিতে পারবেন কি না, ঠিক নেই। প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ এসে রিপোর্ট নিয়ে যাচ্ছে। কারও জ্বর আছে কি না, জানতে চাইছে।”

সেখানেই আটকে আছেন স্ত্রীরোগের চিকিৎসা করাতে কলকাতায় আসা স্বামী-স্ত্রী শার্দূল ও শরমিনা। তাঁরা বললেন, “গেস্ট হাউসের মালিক রবিবারের পরে ঘর ছাড়তে বলেছেন। যেখানেই ফোন করছি, বাংলাদেশি শুনলেই ভাড়া বাড়িয়ে বলছে। কোথাও না পেলে পেট্রাপোলে গিয়ে থাকব।” শরমিনা বললেন, “লকডাউন হলে তো ওই পর্যন্তও যেতে পারব না। এখনই সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া ভাল।”

মির্জা গালিব স্ট্রিট লাগোয়া কোলিন লেনের ভ্রমণ সংস্থার টিকিটের দোকানে আবার প্রবল উত্তেজনা এক বাংলাদেশিকে নিয়ে। সুকুমার বিশ্বাস নামে ওই ব্যক্তিকে দেশে ফেরার কোনও পথই খোলা নেই বলে দোকান থেকে জানানো হলেও তিনি মানতে নারাজ। শেষে কোনও রাস্তাই খোলা নেই বুঝে সুকুমারবাবু বললেন, “সঙ্গে থাকা টাকা প্রায় শেষ। কাল থেকে কী খাব, জানি না। ১২ দিন আগে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছিলাম। এই ঘোরাই না শেষ ঘোরা হয়ে দাঁড়ায়..!” দেশে ফিরতে না পারার আতঙ্কে বুজে আসে তাঁর গলা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement