সল্টলেকে ফ্ল্যাট বিক্রির সেই বিজ্ঞাপন। - নিজস্ব চিত্র
সল্টলেকে আকাশছোঁয়া আবাসন হচ্ছে! বিলাস-ব্যসনের সব আয়োজন মজুত। ফ্ল্যাট নিতে চাইলে সত্বর যোগাযোগ করুন।
বেসরকারি প্রোমোটার সংস্থার ফোন নম্বর দেওয়া ঝাঁ চকচকে হোর্ডিং ঝুলছে উপনগরীর কেন্দ্রস্থলে। সিএ আইল্যান্ডের মতো জমজমাট জায়গায় নজরকা়ড়া বিজ্ঞাপন দেখে বহু লোক ফোনও করে ফেলেছেন। সল্টলেকে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ কে ছাড়ে!
বিজ্ঞাপন মোতাবেক, ‘ফোর বেডরুম’ ফ্ল্যাটের সুসজ্জিত ‘হাইরাইজ’টি মাথা তুলবে করুণাময়ীর কাছে। কিন্তু সল্টলেকে বেসরকারি কোম্পানি ফ্ল্যাট বানাবে কী ভাবে? এখানকার সব জমিই তো নগরোন্নয়ন দফতরের!
আসা-যাওয়ার পথে হোর্ডিং দেখে নবান্নের এক অফিসারের মনে প্রশ্ন জেগেছিল। বস্তুত হোর্ডিং খুঁড়তে গিয়েই বেরিয়ে পড়েছে অনিয়মের কেউটে সাপ! দেখা যাচ্ছে, সরকার এ সম্পর্কে কিছুই জানে না! কী রকম?
খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, আট কাঠারও বেশি আয়তনের সংশ্লিষ্ট জমিটি নগরোন্নয়ন দফতর ক’বছর আগে বরাদ্দ করেছে সমাজকল্যাণ দফতরকে। অর্থাৎ, সেটা সরকারেরই জমি। প্রোমোটার ওখানে ফ্ল্যাটবাড়ির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কী ভাবে জানতে চাওয়া হলে নগরোন্নয়ন-সচিব দেবাশিস সেন সোমবার বলেন, ‘‘সমাজকল্যাণ দফতরের আবেদনেই জমিটা ওদের দেওয়া হয়েছিল। ওরাই বলতে পারবে, পরে তা অন্য কারও হাতে গিয়েছে কি না।’’ দেবাশিসবাবুর মতে, সরকারি জমি বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়ে থাকলে মোটেই উচিত কাজ হয়নি।
সমাজকল্যাণ কর্তারা কী বলেন?
দফতরের সচিব রোশনি সেনের বক্তব্য: এটা ঠিক যে, নগরোন্নয়ন দফতর জমিটা তাঁদের দিয়েছিল। তাঁরা সেটি তুলে দেন সমাজকল্যাণ বোর্ড (সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড)-এর হাতে। কারণ, স্বশাসিত সংস্থাটি মহিলাদের হস্টেল বানানোর জন্য জমি চেয়েছিল।
কিন্তু কর্তাদের একাংশের উপলব্ধি, হস্টেল প্রকল্প চলে গিয়েছে আড়ালে। তার বদলে জমির সিংহভাগ বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থাকে। আর পুরো ব্যাপারটা করা হয়েছে সমাজকল্যাণ দফতরকে অন্ধকারে রেখে, যাকে পুরোপুরি ‘অবৈধ ও অনৈতিক’ কাজ হিসেবে দেখছেন সচিব। দফতরের খবর: বোর্ডের থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে।
ঘটনা যে সময়কার, তখন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ডের মাথায় ছিলেন ছিলেন অপর্ণা নিয়োগী। কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর অপর্ণাদেবী ২০১২-য় বোর্ডের চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন। ২০১৪-র অগস্ট পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁরই আমলে বেসরকারি সংস্থাটিকে সল্টলেকের জমিতে আবাসন গড়ার অধিকার দেওয়া হয়। কোন যুক্তিতে?
অপর্ণাদেবীও এখন বুঝেছেন, কাজটা ঠিক হয়নি। ‘‘আসলে ওখানে আমাদের একটা একটা মহিলা আবাস গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু টাকা ছিল না। তাই পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলে প্রকল্প রূপায়ণের সিদ্ধান্ত হয়।’’— বলছেন তিনি। বোর্ড সূত্রের খবর: ঠিক হয়েছিল, জমির একাংশে প্রোমোটার মহিলা আবাস বানিয়ে দেবে। বাকি অংশে ফ্ল্যাট বানিয়ে তা বিক্রি করে নিজের লাভ তুলে নেবে। অপর্ণাদেবীর দাবি— তখন কেন্দ্রীয় সরকারও পিপিপি মডেলে পরিকাঠামো গড়ায় উৎসাহ দিচ্ছিল। আর তাতে ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়েই বোর্ড-সদস্যদের অনুমতিক্রমে রীতিমতো কোরাম করে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়।
কিন্তু রাজ্য সরকারের সম্মতি কি নেওয়া হয়েছিল? অপর্ণাদেবীর জবাবেই স্পষ্ট, বোর্ড সম্মতির অপেক্ষা রাখেনি। তিনি বলছেন, ‘‘রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। এক বছরেও জবাব মেলেনি। তাই কেন্দ্রীয় উদ্যোগকে মাথায় রেখেই প্রোমোটার কোম্পানির সঙ্গে পিপিপি-চুক্তি হয়ে যায়।’’
এবং এ ভাবেই কার্যত সরকারের অগোচরে সল্টলেকের মহার্ঘ সরকারি জমি নিয়ে মুনাফা লোটার সুবর্ণ সুযোগ বেসরকারি সংস্থাকে করে দেওয়া হয়েছে বলে প্রশাসনের অন্দরে অভিযোগ। যে প্রসঙ্গে রাজ্যের নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ দিন বলেন, ‘‘অর্থ দফতরের অনুমোদন ছাড়া সরকারি জমিতে কোনও ভাবেই পিপিপি মডেলে কেউ কিছু করতে পারে না।’’ তা হলে এ বার কী হবে?
মন্ত্রী জানিয়েছেন, অভিযোগ সত্যি হলে খুব শিগগিরই জমি ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া তাঁরা শুরু করবেন। নগরোন্নয়ন-সচিব এ দিন জানান, বিষয়টি নিয়ে কাল বুধবারই সমাজকল্যাণ দফতরের সঙ্গে তাঁরা জরুরি বৈঠকে বসছেন।
যাদের হোর্ডিং ঘিরে এত কাণ্ড, সেই প্রোমোটার সংস্থার কোনও প্রতিক্রিয়া অবশ্য মেলেনি। তাদের তরফে কেউ মুখ খুলতে চাননি।