অসহায়: স্ট্রেচারে বসে চিকিৎসার অপেক্ষায় চন্দ্রকান্ত জেটি। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
‘রেফার’ করার ব্যাধি সারে না, শয্যা না-থাকার কারণ দেখিয়ে রোগী ফেরানোও ঘটতেই থাকে। এর মধ্যেই আবার চলে দালাল-চক্র। সরকারি হাসপাতালের এই দৈন্য কি ঘুচবে না কোনও দিন?
পুকুরটাকে মাঝখানে রেখে বি টি রোড থেকে অর্ধ চক্রাকার দু’টি রাস্তা গিয়ে মিশছে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মূল চত্বরে। তার একটি ধরে সরাসরি চলে আসা যায় জরুরি বিভাগে। সেই রাস্তার ধারে সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে। সবই বেসরকারি। জরুরি বিভাগের সামনেই যে ব্যক্তি স্ট্রেচারে শুয়ে রয়েছেন, তাঁর নাম চন্দ্রকান্ত জেটি। বয়স ৬৬। রবিবার দুপুরের ঘটনা।
সেরিব্রালে আক্রান্ত চন্দ্রকান্তবাবুর পরিজনেরা ছোটাছুটি করছেন তাঁকে কত ক্ষণে ভর্তি করাবেন। কিন্তু মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান করানোর পরেই তাঁদের আশাভঙ্গ হল। হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দেওয়া হল এখানে চিকিৎসা হবে না। হতভম্ভ পরিজনেরা কী করবেন বুঝতে না পেরে বসে পড়লেন মাটিতে। চন্দ্রকান্তবাবুর স্ত্রী বলেন, “আমাদের লোকবল নেই। এখানে চিকিৎসা হলে ভাল হত। কিন্তু এখানে মস্তিষ্কের চিকিৎসার ব্যবস্থাই নেই।” দীর্ঘ অপেক্ষার পরে শেষ পর্যন্ত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটলেন তাঁরা।
রেফারের গেরোয় যে কত বড় ক্ষতি হতে পারে এই হাসপাতালে এসে গত জুলাই মাসে তার প্রমাণ পেয়েছেন ইছাপুরের দম্পতি। তাঁদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলেকে এনেও এই হাসপাতালে ভর্তি করতে পারেনি। তাঁকে এক বার ইএসআই হাসপাতালে, এক বার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানকার হাতে লেখা কোভিড রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁকে ভর্তি না করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়েও ভর্তি হতে পারেনি বছর আঠারোর কিশোরটি। শেষ পর্যন্ত যত ক্ষণে তাঁকে ভর্তি করানো হয়, তত ক্ষণে মৃত্যু হয় তাঁর। তার পর থেকে এই হাসপাতাল নিয়ে হাজারো অভিযোগ সামনে এসেছে।
ঘোলা থানার নাটাগড়ের বাসিন্দা, বছর সত্তরের অঞ্জলি দে রবিবার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে আসেন। কিছু পরীক্ষার পরে তাঁকেও আর জি করে রেফার করা হয়। ছেলে রবীন দে এবং তাঁর স্ত্রী জরুরি বিভাগের বাইরে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে পরিজনেদের ফোন করে যাচ্ছেন। রবীনবাবু বলেন, “আর জি কর হাসপাতালে গিয়ে শয্যা মিলবে কি না, তার নিশ্চয়তা কোথায়! সেখানে যদি মাকে ভর্তি করতে না পারি, তা হলে কী করব? কোথায় ঘুরব?” অনেক দরদাম করে শেষ পর্যন্ত একটা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে রওনা হলেন অনিশ্চয়তার পথে।
ওই অ্যাম্বুল্যান্স নিয়েও হাজারো অভিযোগ। এক রোগীর আত্মীয় বললেন, সামান্য দূরত্বের আর জি কর হাসপাতাল যেতে কেউ চার হাজার হাঁকছেন, কেউ ছ’হাজার। দরদাম করে সামান্য কমে ওই অ্যাম্বুল্যান্স নিতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীর আত্মীয়েরা। অভিযোগ, বাইরে থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করলে হাসপাতাল চত্বরের অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা তাদের ঢুকতে বাধা দেন। ফলে তাঁদের অন্যায় দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া রোগীর পরিজনেদের আর কোনও রাস্তা থাকে না।
অভিযোগের তালিকা আরও দীর্ঘ। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের রেফার করা হলেও মাঝপথে নানা ভাবে ভয় দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে অ্যাম্বুল্যান্সের চালকদের বিরুদ্ধে। এই হাসপাতালে রোগী নিয়ে এসে ভর্তি করানোর জন্য স্ট্রেচার নিতে গেলেও দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীর বাড়ির লোকেদের। অভিযোগ, আধার কার্ড বা ভোটার কার্ড জমা দিলে তবেই স্ট্রেচার মেলে। পরিচয় পত্র সঙ্গে না থাকলে মোবাইল ফোন জমা দিয়ে তবে স্ট্রেচার নিতে হয়। জরুরি বিভাগের সামনে লাল কালিতে সেই নির্দেশ সাঁটানো রয়েছে।
২০১১ সালে এই হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজে উন্নীত হয়। কলেজের অধ্যক্ষ রঘুনাথ মিশ্র বলেন, “এমবিবিএস পড়াতে গেলে যে বিভাগগুলি থাকা জরুরি, সেগুলি এখানে রয়েছে। কার্ডিয়োলজি, নিউরোলজির মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ নেই বলে সেই চিকিৎসা দিতে আমাদের সমস্যা হয়। সেই জন্য রেফার করা। আর তা ছাড়া দীর্ঘদিন এই হাসপাতালে কোভিডের চিকিৎসা হয়েছে। সবে দেড়শোটি শয্যায় সাধারণ রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। চেষ্টা চলছে, যাতে কোনও অভিযোগ না ওঠে। অ্যাম্বুল্যান্স নিয়েও অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।”
(শেষ)