সঙ্কট: গোবরা অঞ্চলে জলের আকাল। তাই প্লাস্টিকের নলকূপের পাইপ কলের মুখে লাগিয়ে পাম্প করে জল নিচ্ছেন বাসিন্দারা। নিজস্ব চিত্র।
এ যেন বিবিধের মাঝে সমস্যার মহা মিলন।
কলকাতা পুরসভার সাত নম্বর বরোয় ঘুরলে তেমনটাই মনে হতে পারে। এলাকা জুড়ে বহুতল, শপিং মলের সঙ্গে সহাবস্থান বস্তির। কোথাও পানীয় জল নিতে মানুষকে প্লাস্টিকের নলকূপ ব্যবহার করতে হয় কিংবা পুরসভার কলে পাইপ লাগিয়ে মুখ দিয়ে জল টানতে হয়। কোথাও আবার জমা জলের সমস্যা নিয়ে সরব তাঁরা। এর সঙ্গেই রয়েছে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার যন্ত্রণা। পাল্টা যুক্তিতে বিদায়ী ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর কিংবা বরো কোঅর্ডিনেটরদের দাবি, পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক ভাল।
এই বরোর ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের গোবরা অঞ্চলে ঢুঁ মারতেই নজর গেল রাস্তার কলের দিকে। অনেক বাড়িতেই রয়েছে দেড় ফুটের প্লাস্টিকের নলকূপ। বাসিন্দাদের দাবি, পুরসভার কল থেকে জল বার করতে ওই নলকূপই ভরসা। যদিও কলের মুখে সেই নলকূপের পাইপ লাগিয়ে চাপ দিলে যে জল বেরোবেই, সেই নিশ্চয়তা নেই। বরং বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, জলের জন্য হাপিত্যেশ করাটাই তাঁদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
এর প্রতিবাদে সম্প্রতি পথে নেমেছিলেন তাঁরা। তার জেরে শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেও জল-সমস্যার বিশেষ সুরাহা হয়নি বলে অভিযোগ। একটি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, কখন ৪টে ২০ বাজবে, সেই অপেক্ষায় লোকজন। কারণ, জল আসবে যে! কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও জল না আসায় এক ব্যক্তি কলের মুখে নলকূপের পাইপ লাগিয়ে পাম্প করতে শুরু করলেন।
ওই পাড়ার পাশের পাড়ায় দেখা গেল, পর পর জলের কল খটখটে শুকনো। কয়েকটি ঢাকা পড়েছে বালি-সিমেন্টের স্তূপে। স্থানীয় বাসিন্দা ঝর্না দে বললেন, ‘‘রোজ একই ঘটনা। খাওয়ার জল কিনে খেলেও ঘরের কাজ, স্নানের জল পাব কোথায়? পুরসভার গাড়ি জল দিতে এলে মারামারি বেধে যায়। ’’ যদিও ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর জলি বসুর দাবি, ‘‘সুযোগ পেলে প্রথমেই জলের সমস্যা মেটাব।’’
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জমা জলের যন্ত্রণা আর মশার উপদ্রব। বাসিন্দারা জানালেন, গত কয়েক বছরে ঘরে ঘরে ছড়িয়েছে ডেঙ্গি আর ম্যালেরিয়া। পুর তালিকাতেও এই ওয়ার্ড ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত। পানীয় জল, নিকাশি কিংবা মশাবাহিত রোগের অভিযোগ এসেছে ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকেও।
ছবিটা আলাদা নয় মধ্য কলকাতার ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশেও। ওই ওয়ার্ডটি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অধীনে। সেখানকার কলিন লেন, আসিফ গলি, ইসমাইল লেনে বস্তিবাসীদের অনেকেরই অভিযোগ, পানীয় জল পর্যাপ্ত নয়। রাস্তায় ঘুরলে চোখে পড়বে, জেরিক্যানে করে জল নিয়ে আসছেন লোকজন। এই ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে পার্ক স্ট্রিট, শেক্সপিয়র সরণি, ক্যামাক স্ট্রিট-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। একটু বৃষ্টিতেই সেখানে জল দাঁড়িয়ে যাওয়া নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে বাসিন্দাদের। আরও অভিযোগ, পরিত্যক্ত বাড়িগুলি মশার আস্তানা। পার্ক স্ট্রিটে অ্যালেন পার্কের উল্টো দিকে এমনই একটি বাড়িতে ঢুকে গেল, পড়ে রয়েছে ভাঙা কমোড, বেসিন। কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষীর দাবি, কদাচিৎ পুরকর্মীরা মশার তেল দিতে আসেন। যদিও স্থানীয় বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর শুচিস্মিতা ভট্টাচার্য (চট্টোপাধ্যায়) দাবি করছেন, সব ধরনের উন্নয়ন হয়েছে। ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ারও তেমন প্রকোপ নেই।
জল-যন্ত্রণা নিয়ে ক্ষোভ গোপন করেননি পার্ক সার্কাসের কাছে ৬৪ ও ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সামসুল হুদা রোডের বাসিন্দারাও। তাঁদের অভিযোগ, দু’দশকের পুরনো নিকাশি ব্যবস্থা না বদলানোয় এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জল জমা ঠেকাতে রাস্তা উঁচু করা হয়েছে। তার ফল হয়েছে উল্টো। একটু ভারী বৃষ্টিতেই জল ঢুকে যাচ্ছে বাড়িতে। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘অদূরেই ঝাঁ-চকচকে শপিং মল। সেটি যতটা সুন্দর, ততটাই অপরিচ্ছন্ন আমাদের এলাকা।’’ জল জমার সমস্যার কথা উঠেছে ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের সুইনহো লেন, পি নস্কর লেনের মতো জায়গা থেকেও।
ইএম বাইপাসের চিংড়িঘাটা মোড় থেকে খালধার বরাবর সামান্য এগোলেই শুরু সাত নম্বর বরো। ট্যাংরা, তপসিয়া, পিকনিক গার্ডেন, কসবার বিস্তীর্ণ এলাকা, বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাস, মল্লিকবাজার, পার্ক স্ট্রিটের মতো অঞ্চল যার অধীনে। এই বরোর ৬৬ এবং ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে পার্ক সার্কাস কানেক্টর। যা জুড়েছে সায়েন্স সিটি এবং চার নম্বর সেতুকে। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই সেই রাস্তা ছোট ডোবায় পরিণত হয়। পুরসভা সূত্রের খবর, ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে মিলনমেলার পিছন দিকে নিকাশি নালা করে জমা জল চৌবাগা পাম্পিং স্টেশনের দিকে বার করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল ভোটের আগেই। ওই ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর স্বপন সমাদ্দারের কথায়, ‘‘এ বার আমার ওয়ার্ড বদল হয়েছে। তবে ভোটের পরে এই প্রকল্প নিশ্চয়ই বাস্তবায়িত করা হবে।’’ স্বপনবাবু এ বার ৫৬ নম্বরের প্রার্থী।
সাত নম্বর বরোর পিকনিক গার্ডেন, তপসিয়া, ট্যাংরায় আবার বড় অভিযোগ বেআইনি নির্মাণ। আরও অভিযোগ, এরই জন্য অনেক বস্তি এলাকা জলসঙ্কটের মুখোমুখি। বাইপাসে মেট্রোপলিটন লাগোয়া এক ঝিল বুজে গিয়ে মশার আঁতুড়ঘরে পরিণত। বিস্তীর্ণ এই এলাকা রেহাই পায়নি দখলদারির হাত থেকেও।
যদিও বরোর চেয়ারম্যান জীবন সাহা জানাচ্ছেন, এত সমস্যার মধ্যেও তাঁরা ইতিবাচক দিক হিসাবে দেখছেন ‘জয় হিন্দ’ জল প্রকল্পটিকে। তাঁর দাবি, এই প্রকল্প তৈরি হওয়ায় পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ অংশের জলসঙ্কট অনেকটাই মিটেছে। জীবনবাবু বলেন, ‘‘খালগুলির নাব্যতা বাড়ায় জল জমার সমস্যা কম। তবে এটা ঠিক, কিছু সমস্যা রয়েছে। এলাকায় বুস্টার পাম্পিং স্টেশন বসাচ্ছি। তত দিন একটু কষ্ট করতে হবে। আর বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ এলে আমরা পুরসভার বিল্ডিং দফতরে জানাই।’’
গত পুর নির্বাচনে এই বরোর ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে আরএসপি ছাড়া বাকি সব ওয়ার্ডেই জিতেছিল তৃণমূল। যদিও শেষ পর্যন্ত ৬৫ নম্বরের কাউন্সিলর নিবেদিতা শর্মা তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এ বারও তিনি তৃণমূলেরই প্রার্থী।