শহরের কেন্দ্রে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অনুষ্ঠান হবে, তা জানা ছিল আগেই। সাত দিন আগে সিটু-সহ বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের ট্যাক্সিচালকদের সভা এবং পরিবহণ ভবন অভিযানের কথাও জানতে পারে লালবাজার। আজ, বৃহস্পতিবার একই দিনে এই ধরনের দু’টি কর্মসূচি ঘিরে কী হতে পারে, তা অবশ্য তখনও আঁচ করতে পারেননি কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। টনক যখন নড়ল, তত ক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গিয়েছে। লালবাজার সূত্রের খবর, বুধবার দুপুরে বিরোধী পক্ষের শ্রমিক নেতাদের ডেকে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিতে বলেন লালবাজারের কর্তারা। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে রাজি হননি নেতারা। সমাবেশ বেআইনি ঘোষণা করেও তাদের টলাতে পারেনি পুলিশ।
একেই শাসক দলের সমাবেশের জেরে পথেঘাটে যানজট কার্যত নিশ্চিত। তার উপরে ট্যাক্সিচালকদের সমাবেশের জন্য রাস্তায় মিলবে না ট্যাক্সি। সব মিলিয়ে জোড়া রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আজ, বৃহস্পতিবার কাজের দিনে শহরবাসীর ভোগান্তি হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল বলে মনে করছেন লালবাজারের একাংশ।
বেলা এগারোটায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সমাবেশ গাঁধী মূর্তির পাদদেশে। সেখানে প্রধান বক্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। থাকবেন শাসক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীরা। এর জেরে সকাল থেকেই কলকাতার বিভিন্ন দিক থেকে আসা সমাবেশমুখী মিছিলে তুমুল যানজটে অবরুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা মধ্য কলকাতা এবং অফিসপাড়ার বিভিন্ন রাস্তার। অন্য দিকে, দুপুর দুটো নাগাদ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে ট্যাক্সিচালকদের জমায়েতে যোগ দেবে সিটু, এআইটিইউসি, আইএনটিইউসি-সহ রাজ্যের ছোট-বড় প্রায় সবক’টি বিরোধী শ্রমিক সংগঠন। সেখান থেকে তাঁদের পরিবহণ ভবন অভিযান কর্মসূচি রয়েছে। ফলে যানজট তো বটেই, গত ৭ থেকে ১৮ অগস্ট দফায় দফায় ট্যাক্সিচালকদের সমাবেশের অভিজ্ঞতা থেকে প্রশাসনের কর্তারাই বলছেন, বেশির ভাগ চালকই ট্যাক্সি নামাবেন না। ফলে ভুগবেন হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশন ও বিমানবন্দরে আসা যাত্রীরা। অর্থাৎ সকাল থেকে বিকেল অবধি এই জোড়া কর্মসূচির জেরে শহরবাসীর তুমুল নাকাল হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিশ্চিত করে একই দিনে শাসক দলের পূর্ব ঘোষিত রাজনৈতিক সমাবেশ এবং ট্যাক্সিচালকদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হল কেন?
গত ২১ অগস্ট পুলিশকে লিখিত ভাবে এই অভিযানের কথা শ্রমিক সংগঠন দু’টির তরফে জানানো হয়েছিল। তখনকার মতো পুলিশের তরফে মৌখিক অনুমতিও মিলেছিল বলে দাবি শ্রমিক সংগঠনগুলির। কিন্তু দুই সমাবেশের যুগলবন্দিতে দুর্ভোগ চরমে ওঠার আশঙ্কায় মঙ্গলবার কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকার লালবাজারে শ্রমিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে এই অভিযান বাতিল করার অনুরোধ জানান। কিন্তু, পুলিশকর্তাদের শ্রমিক নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, পরিবহণ ভবন অভিযানের সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গিয়েছে, তাই এই কর্মসূচি বাতিল করা কার্যত অসম্ভব। পুলিশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বুধবার সিটু এবং এআইটিইউসি নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছেন আজ, বৃহস্পতিবার ট্যাক্সিচালকদের পূর্বনির্ধারিত পরিবহণ ভবন অভিযান হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পুলিশও ‘বেআইনি’ ঘোষণা করেছে ট্যাক্সিচালকদের ওই কর্মসূূচিকে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মসূচির অনুমতি রয়েছে। তবে ট্যাক্সি ইউনিয়নকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
এ দিন সিটু-র সদর দফতর শ্রমিক ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করে সিটু এবং এআইটিইউসি নেতারা জানিয়ে দেন, পরিবহণ ভবন অভিযানে হাজার হাজার ট্যাক্সি চালক অংশগ্রহণ করবেন এবং অভিযান হবে শান্তিপূর্ণ। যদি পুলিশ বাধা দেয়, তা হলে সকলেই গ্রেফতার বরণ করবেন বলে জানান সিটু নেতা অনাদি সাহু।
কিন্তু শাসক দলের পূর্ব ঘোষিত সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও আগে ট্যাক্সিচালকদের এই কর্মসূচির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কেন? কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “অনুমতি দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ, এ নিয়ে অযথা রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হত।” তবে যানজট ও নিরাপত্তাজনিত কোনও অসুবিধা হবে না বলেই দাবি কলকাতা পুলিশের কর্তাদের।
তবে গত মাস থেকে ট্যাক্সিচালকদের নানা কর্মসূচি যে ভাবে বারবার সরকারকে বিব্রত করেছে, তাতে রাস্তায় রাখা ট্যাক্সি ঘিরে অশান্তি ছড়ানোর আশঙ্কা করছে প্রশাসনের একাংশ। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “আমরা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি। পুলিশ পিকেট, থানার পুলিশকর্মীরাও রাস্তায় থাকবেন।”
দুর্ভোগ যে হবে না, এমনটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাও। তাঁর বক্তব্য, “২১ জুলাইয়ের মতো প্রতি বছর ২৮ অগস্টও সমাবেশ হয়। আমরা রাস্তার ধার দিয়েই মিছিল করব। তা সত্ত্বেও যদি কোথাও ছোটখাটো সমস্যা হয়, সে জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।”
সিটু নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, দুটো অনুষ্ঠান পৃথক সময়ে এবং শহরের দু’দিকে। তাই কোনও সমস্যা হবে না। সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কর্মসূচির সময় ভিন্ন, জায়গাও আলাদা। ফলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।” শহরের রাস্তায় সকাল থেকে ট্যাক্সি মিলবে কি না, এ নিয়ে অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, “পরিবহণ ভবন অভিযানে যোগ দিতে ট্যাক্সিচালকেরা গাড়ি বার না-করলে তার দায় তো আমাদের নয়।”
তবে ট্যাক্সিচালকেরা যে তাঁদের দাবিতে এখনও অনড়, তা-ও এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন অনাদিবাবু। ২২ জন ট্যাক্সিচালকদের বিরুদ্ধে সরকারের আনা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “যাত্রী ও চালকদের স্বার্থে সরকারের উচিত আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা।”