পরিবর্তন: বাঁ দিকে-আশির দশকে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁয় এ ভাবেই উদ্যাপন করা হত বড়দিন। ডান দিকে- এখন রকমারি সান্তা টুপি ও চশমা পরে উৎসাহীদের ঢল নামে পার্ক স্ট্রিটে। ফাইল চিত্র
বাতাসে কেকের গরম মশলার সুরভি বা ধ্রুপদী পামিয়ের বিস্কুটের চিনির গুঁড়ো! গাউন, ডিনার জ্যাকেট, বো-টাইয়ের ঢল। ছবিটা এখনও চোখে ভাসে পার্ক স্ট্রিট পাড়ার ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধের।
এখন অবশ্য তার বদলে রয়েছে ঝলমলে আলো জ্বলা শিং, খরগোশ চুলের ব্যান্ড আর রকমারি সান্তা টুপি। বয়স ভুলে হঠাৎ উচ্ছল সদা গোমড়া, খিটখিটে গৃহকর্তাও। বড়দিনের সন্ধ্যায় সে দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসছিলেন সত্তরোর্ধ্ব নীতিন কোঠারি। তত ক্ষণে ভিড়ের চোটে পুলিশ যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে শহরের উৎসব-তীর্থে। ‘‘আমি তো কলকাতার বড়দিনকে দেখছি সেই পঞ্চাশের দশক থেকে। পার্ক স্ট্রিট-নিউ মার্কেট পাড়া তখন কলকাতার তাজমহল! কিন্তু এমন ভিড় অভাবনীয়। তখন দশ জনের ভিড় হলে এখন হাজার লোকের সমাবেশ ঘটে।’’
মোক্যাম্বো-পিটার ক্যাটের কর্ণধার নীতিনের মতো একই অভিজ্ঞতা ট্রিঙ্কাজ়ের কর্ণধার দীপক পুরীর। দু’জনেই জানাচ্ছেন, তখনকার কলকাতার বড়দিন বা বর্ষবরণ বাদামি সাহেবদের হাঁকডাকেই আটকে থাকত। তার বদলে এখন দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া-হুগলি কিংবা আরও দূর মফস্সলও বছর শেষের পার্ক স্ট্রিটে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আগেও নানা কিসিমের কাগজের রঙিন টুপি দেখা যেত পার্ক স্ট্রিট পাড়ায়। এখন চিনা ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ়ের পুতুল বা রঙিন শিঙে ছেয়ে গিয়েছে। কোনও কোনও প্রবীণের তাতে মন ওঠে না। ‘‘সান্তা ক্লজ়ের স্লেজের হরিণের শিং কি এমন অদ্ভুত দেখতে হয়।’’— নিউ মার্কেটের শতাব্দীপ্রাচীন উপহার-বিপণি ইয়াকুব মল্লিকে গজগজ করছিলেন জনৈক প্রৌঢ়া।
ষাটের দশকের কলকাতা মানে সেরা সব কর্পোরেটের পীঠস্থান, দেশ-বিদেশের নামজাদাদের ভিড়। তখন সাধারণ মধ্যবিত্তকে কিন্তু পার্ক স্ট্রিটে তত দেখা যেত না। এ কলকাতায় হতদরিদ্র মাতালও বড়দিনে ভাতের বদলে কেকের টানে মরিয়া। তখন ছিল মেরেকেটে খান দশেক রেস্তরাঁ। আর এখন পার্ক স্ট্রিট ও লাগোয়া এলাকায় ৬০-৬৫টি ছোটবড় রেস্তরাঁ। তবে ক্রিসমাস লাঞ্চে একটা ভাল স্টেক বা রোস্ট খেতেই হবে, এমন চাহিদার লোক কম। তার বদলে কোথাও একটা হইহই করে বিরিয়ানি বা চাইনিজ় খেয়ে নিলেই হল। রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলা, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-সুকুমার রায়দের বাড়ির ছেলে প্রসাদরঞ্জন রায় আজকাল ‘ক্রিসমাস লাঞ্চ’ সারতে ক্যালকাটা ক্লাবটাবেই যান। ভিড় ঠেলে পার্ক স্ট্রিটে যেতে খুব একটা ইচ্ছে করে না তাঁর। তবে তাঁরও ছোটবেলা জড়িয়ে রয়েছে ট্রিঙ্কাজ়-কোয়ালিটির নানা সুখস্মৃতির সঙ্গে।
পার্ক স্ট্রিটের সাবেক রেস্তরাঁ-কর্তাদের মতে, সরকারি উদ্যোগে গোটা রাজপথ আলোয় সাজানো বা অ্যালেন পার্কের অনুষ্ঠান— সবই খুব ভাল উদ্যোগ। কলকাতার বহুত্বকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আজকের দিনে খুবই জরুরি। এ বিষয়ে একমত লা মার্টিনিয়র ও প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, শিক্ষাবিদ দেবী করও। এখনও বেঙ্গল ক্লাব বা লোরেটো স্কুল-কলেজে যাতায়াতের সূত্রে পার্ক স্ট্রিট পাড়া দেখা হয় তাঁর। ‘‘এমনিতে ঠিকই আছে। তবে ইদানীং তেড়েফুঁড়ে উৎসব-উদ্যাপনের বিষয়টি তত ভাল লাগে না। এখন সব উৎসবই এক রকম লাগে। বড়দিনের পুরনো চরিত্রটা পাই না।’’— বলছেন তিনি।