সিদ্ধিলাভের প্রস্তুতি। কালীঘাটের পটুয়াপাড়ায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
জলন্ত বাল্বের উত্তাপে তাজা রাখা হচ্ছে চকোলেট বোমা তৈরির মশলা। দক্ষিণ শহরতলির চকোলেট বোমা তৈরির আঁতুড়ঘরে এখন গণেশ চতুর্থীর ছোট ছোট অর্ডারের প্রস্তুতি। কিন্তু কিছুটা হলেও বাদ সেধেছে বর্ষার জলীয় আবহাওয়া। মশলায় ভিজে ভাব থেকে যাচ্ছে। প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন বলে দাবি করছেন কারিগররা। কৃত্রিম ব্যবস্থায় ভিজে মশলা শুকোনো হচ্ছে।
বছর তিনেক হল গণেশ চতুর্থী উপলক্ষে চকোলেট বোমা কেনার হিড়িক শুরু হয়েছে। দিন কয়েক পরেই গণেশ চতুর্থী। দরদাম করতে চকোলেটের আঁতুড়ঘর বাজারে হানা দেওয়া হয়েছিল। কালীপুজোর সময় যেমন চারিদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো ইতিউতি অস্থায়ী দোকানের আড়ালে বস্তা ভরা চকোলেট বোমা পাওয়া যায়, তেমন নেই। বাতাসে বারুদের তীব্র গন্ধ নেই। ‘দাদা এ দিকে আসুন’ বলে হাত ধরে টানাটানি নেই। কিন্তু বাজারে চকোলেট বোমা রয়েছে। তা বড় রাস্তা ছেড়ে কিছুটা ভিতরে যাওয়ার পর মালুম হচ্ছে। কিছু বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই নাকে আসছে বারুদের গন্ধ।
রাস্তা ছেড়ে এক পরিচিত বাজির কারখানায় গিয়ে হাজির হলাম। কালীপুজো-দীপাবলির সময় চকোলেট বোমা নিয়ে গিয়েছি, থুড়ি ‘অর্ডার’ দিয়ে গিয়েছি একাধিক বার। বছর চারেক ধরে খবরের স্বার্থে ওই বাজারের নানা কারখানায় শুধু ‘অর্ডার’ দিয়েছি। কিছু টাকা অগ্রিমও। দু-এক প্যাকেট চকোলেট বোমা নিয়েছি মাত্র। কিন্তু এক বাজি কারখানার মালিকের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
রাস্তার পাশে দোতলা বাড়ির পিছনেই ওই কারখানা। সাত সকালে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। ওই পরিচিত কারখানায় দরজা কড়া নাড়লাম। দরজা খুলল বছর কুড়ির একটি ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘দাদা আছেন।’’ বলল, ‘‘আছেন। ভিতরে আসুন।’’ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ঘরে এলেন ওই ব্যবসায়ী। আমি ওঁর কাছে শিলিগুড়ির ব্যবসায়ী বলেই পরিচিত। ফের নিজের পরিচয় দিলাম। পাশের একটি চেয়ার টেনে বসলেন কারখানার মালিক, মুখটা কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম। কয়েক দিন পর তো গণেশ চতুর্থী। চকোলেট বোমা তৈরি করছেন কি না, তা খোঁজ নিতে এলাম। কয়েক দিন পরে এসে কিছু নিয়ে যেতে পারি।
‘চলুন কারখানায় যাই,’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠ়লেন ওই ব্যবসায়ী। বাড়ির পিছনের কারখানায় নিয়ে গেলেন। কারখানায় জনা দশেক কারিগর মাথা নিচু করে কাগজের খোলে মশলা ভরে চলেছেন। ঘরের মেঝেতে সকলের সামনেই তিন ফুট লম্বা ও আড়াই ফুট চওড়া কাঠের ছোট বাক্স ভর্তি চকোলেটের মশলা। পাশে সুতলি দড়ি। বাক্সের ভিতরে মশলার মধ্যে একটা ২০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। কাগজের খোলে মশলা পুড়ে চকোলেট বোমা তৈরি হচ্ছে। জলন্ত বাল্বের গরমে ভিজে মশলা একেবারে ঝরঝরে। রোদের তাপের জায়গায় জলন্ত বাল্বের উষ্ণতা।
কারখানার এক পাশে দু’টি চেয়ার নিয়ে বসলাম আমরা। কথার ফাঁকে চা এসে গেল। কারখানার মালিকের কথায়, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকেই মূলত চকোলেট বোমা তৈরি করা শুরু করি। বর্ষার সময় আতসবাজি তৈরি করা যায় না। মশলায় ভিজে ভাব থাকলে রংমশাল, তুবড়ি সবই ফ্লপ করবে। কিন্তু কালীপুজোয় দেদার চকোলেট বোমা বিক্রি হয়। পুলিশি অভিযানের ঝামেলা থাকে। তাই মাস খানেক আগে থেকেই তৈরি করা হয়। রাজ্যের বাইরেও তো পাঠাতে হয়। দুর্গাপুজোর সময় থেকেই আতসবাজিতে হাত দেওয়া হয়।
তবে গণেশ চতুর্থী চকোলেট বোমার ব্যবসা বাড়িয়েছে বলে স্বীকার করেন ওই ব্যক্তি। তাঁর কথায়, বছর তিনেক ধরে মোটামুটি বিক্রিও হচ্ছে। তবে তা কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় চলছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন দরদাম।’’ মালিকের কথায়, ‘‘একটু বেশি পড়ে। বর্ষায় কারিগর পাওয়া যায় না। মাঠে ধান চাষ চলে। সেখানেই সব থাকে।’’ মজুরি খুব বেশি পড়ে যায়। কালীপুজোর সময় ১৫০ টাকায় ১০০ চকোলেট বিক্রি করি। এই সময় ১০০ চকোলেটের প্যাকেট ২৫০ টাকা দেবেন আর কী বলব।’’
চেয়ার থেকে উঠে হাতের ইশারায় ডেকে পাশের একটি ছোট ঘরে নিয়ে গেলেন উনি। তক্তপোষের উপর বস্তায় চকোলেট বোমার প্যাকেট ভরে রাখা। ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘আগে দুর্গাপুজো থেকে চকোলেট-ব্যবসা শুরু হত। এখন মাস খানেক এগিয়ে এসেছে। কম হলেও ভালই হচ্ছে।’’ দরজায় এসে বললাম, ‘‘কলকাতায় এসেছিলাম। আপনার সঙ্গে দেখাও হল। দেখি আমার ওখানে কেমন চাহিদা। তার পর ফোন করলে পাঠিয়ে দেবেন।’’ উত্তরে বাজি ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘ওটা হবে না। কালীপুজোয় পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। এখন দাদা লোক নেই। আসুন না। শিলিগুড়ি থেকে কতক্ষণ লাগবে। হাতেগরম নিয়ে যাবেন।’’