পাড়া মানে অলি-গলি আর খানকয়েক বাড়িই নয়, আমার ছোটবেলা, বেড়ে ওঠা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া সব কিছু। বনমালী সরকার স্ট্রিট, দুর্গাচরণ ব্যানার্জি স্ট্রিট, অভয় মিত্র স্ট্রিট ও কিছুটা রবীন্দ্র সরণি— কুমোরটুলির এই পরিসরেই আমার বেড়ে ওঠা।
এ পাড়া মানেই ঠাকুর গড়া। প্রথমে কৃষ্ণনগর থেকে মৃৎশিল্পীরা এসেছিলেন। তখন এত ভিড় ছিল না। পরে পূর্ববঙ্গ থেকে কিছু শিল্পী এলেন। সেই ভিড় বাড়ার শুরু। পঞ্চাশের দশকে মূলত বাড়িতে পুজো হত। সবর্জনীন বলতে ফায়ার ব্রিগেড আর বাগবাজার বুঝতাম। এখন ক্যামেরা ঝোলানো ছেলে-মেয়ের ভিড় তো লেগেই থাকে। ঐতিহ্যবাহী এই জায়গার সৌন্দর্যায়নের কথা ছিল। প্রস্তাব ছিল, কমপ্লেক্স, কমিউনিটি হল, আর্ট গ্যালারি তৈরির। বিদেশিদের সাহায্যে থাকবে আলাদা গাইড। কিছু পুরনোপন্থী মানুষের বাধায় তা হল না এখনও। সবাই আলাদা জমি দাবি করাতে থমকে গেল কাজ।
এখন সারা বছর কাজ চলে এখানে। সুন্দর শোলার কাজ, সাবেক ডাকের সাজও হত এখানে। তা এখন হাতে গোনা কিছু জায়গাতেই রয়েছে। বদলে থার্মোকল দিয়েই নানা সূক্ষ্ম কাজ হয়। তবে মৃৎশিল্পীদের বর্তমান প্রজন্ম আর ব্যবসায় থাকতে চাইছেন না। তাই পুজোর তিন মাস আগে সাহায্যের জন্য গ্রাম থেকে বহু কিশোর চলে আসে। তাদের থাকার ভালো সংস্থান নেই, পর্যাপ্ত শৌচাগারও নেই। ফলে যত্র-তত্র নোংরা হয়। কিছু উন্মুক্ত শৌচাগার থাকায় দূষণও ছড়ায়।
পুজোর আগে ভিড় বাড়তে থাকে। রাস্তা দিয়ে তখন হাঁটা যায় না। যখন সুন্দর প্রতিমাগুলি বেরোয়, তখন গর্ব হয়। নবমী থেকেই পুরনো প্রতিমা জড়ো হয় গুদামে। নতুন রঙের প্রলেপ দিয়ে তৈরি হয় অন্য প্রতিমা। ইদানীং নামী শিল্পীরা চলে যাচ্ছেন শহরের অন্যত্র।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখানে শিল্পীরা কাজ করছেন। চায়না পালের মতো মহিলাশিল্পীরাও আছেন। এখন কুমোরটুলিতে কার্যত লোডশেডিং হয় না। ছোটবেলায় দেখেছি প্রদীপের অল্প আলোয় প্রতিমার চোখ আঁকা হতে। আগে সীসা মেশানো রঙ ব্যবহার হত। এখন তা বন্ধ হওয়ায় দূষণও অনেক কমেছে। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে কুমোরটুলি সর্বজনীন আর কুমোরটুলি পার্কের পুজো দেখা যায়। কয়েক বছর ধরে নানা প্রতিযোগিতা হওয়ায় পুজোয় লোকের ভিড়ও বেড়েছে।
ছোটবেলাটা ছিল স্বপ্নের মতো। আড্ডা, হইচই লেগেই থাকত। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেই ছোটরা ঘুড়ি ওড়াতে ছাদে উঠতাম। গলিতে তখন কাচের গুঁড়ো, সাবু দিয়ে ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া হত। রবিবারগুলোয় বাবা কালী গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাড়িতে জমাটি আড্ডার আসর বসত। আসতেন কে সি দাশের বাড়ির সারদাচরণবাবু, পি বি গুহ, পঙ্কজ রায়, অম্বর রায়, শ্যামবাজারের দাশরথি এস্টেটের মালিক, ওরিয়েন্ট সিনেমার ম্যানেজার। বাবা ভারতীয় ক্রীড়া জগতে যুক্ত থাকায় চুনি গোস্বামী, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসতেন।
ছোটবেলায় দেখেছি বাবা গঙ্গায় মাছ ধরতে যেতেন। মাছ না পেলে হাতিবাগান বা শ্যামবাজার থেকে কিনে এনে বলতেন, ‘আমিই ধরেছি দেখ’। সেই মাছ রান্না করে যেত পাড়ায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি। বাড়ি-বাড়ি খাবার দেওয়ার চলটা তখন বেশি ছিল। পাশের বাড়ির কাকিমা গরম গরম মাছের চপ দিয়ে যেতেন আগে। সে সব অনেক কমে এসেছে।
ছুটির দুপুরগুলোও ছিল মায়াবী। পিসিমার কাটা হিমসাগর খেতে খেতে দেখতাম মালাই বরফ, তিলকুটো, বড়ি, আমসত্ত্ব, আলুকাবলি, আচারওয়ালা, চাবিওয়ালা, ‘শিল-কোটা’ হেঁকে যাচ্ছে। কাপড় দিয়ে বাসন কিনতেন মা-ঠাকুমারা। বহুরূপী আসত কত!
বয়স বাড়ছে বলে কিনা জানি না, ইদানীং বিষাদ ভিড় করে। এখনও পাড়ায় টানা রিকশা দেখে মনে হয়, দুটো পয়সার জন্য রিকশাওয়ালারা যেন ভারবাহী পশুর মতো। দেখে খুব কষ্ট হয়।
এখন ‘সংস্কৃতি’ চর্চা হয় রাত বারোটা অবধি জোরে মাইক চালিয়ে। কয়েক বছর ধরে ঝুলন থেকে রামনবমী — সব উৎসবের ধুম বেড়েছে। সেই উপলক্ষে রাস্তার দু’পাশে দোকান সাজিয়ে বসে়ন অনেকে। যাতায়াতে অসুবিধে হয়। তবে, আজও এ পাড়া মেয়েদের জন্য নিরাপদ।
আগে এখানে দিনে দু’বার সাইরেন বাজত। একটা লালবাজার থেকে। অন্যটা আমাদের বাড়ি থেকে। বাড়ির সাইরেন বাজানোর শুরু ১৯৬২-তে। প্রতিবেশীরা বলতেন সাইরেন-বাড়ি। এই আওয়াজে ১০৯ বছরের পুরনো আমাদের বাড়ির দেওয়ালে ফাটল ধরায় কয়েক বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে।
ছোটবেলায় দেখেছি গঙ্গার জল দিয়ে পাড়া ধুতে। ঘোড়ার জন্যও জলের পাত্র থাকত। এখন গঙ্গার জল আসে না। পুরসভার জলের সরবরাহ ভালো। দিনে দু’বার রাস্তায় ঝাঁট পড়ে। তবুও দোকানের আবর্জনা রাস্তায় পড়ে। মানুষ সচেতন না হলে পরিষ্কার রাখা অসম্ভব।
ইদানীং কিছু সমস্যা হচ্ছে়। বাড়ির উল্টো দিকে সন্ধ্যা হলেই বসে দেশি মদের আসর। আগে পুলিশ টহল দিত। এখন তা বন্ধ। বাড়ির সামনেই অন্যের গাড়ি থাকে। নিষেধ সত্ত্বেও কাজ হয়নি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো। দু’পা হাঁটলেই় চক্ররেল। গঙ্গার ঘাট কাছে। তাই লঞ্চের পথও খোলা। এ পাড়া রবীন্দ্র সরণির কিছুটা নিয়ে। আগে ট্রামের ঘণ্টি শোনা যেত। ট্রাম কমে যাওয়ায় মিষ্টি আওয়াজটা কানে আসে না। নতুন রেস্তোরাঁ এ দিকে থাবা বসায়নি। আজও সন্ধ্যায় চপ-শিঙাড়ার জন্য লাইন পড়ে।
আগে নানা পাখি আসত। ছেলেদের পায়রার ঝোঁক ছিল। মোবাইল টাওয়ারের জন্য চড়ুই-শালিকের সংখ্যা কমেছে। তবে এখন কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে। আগে কর্পোরেশন থেকে নির্বীজকরণ করা হত। বহু দিন হল সে সব আর চোখে পড়ে না।
১৯৪৯ থেকে এই বাড়িতেই রয়েছি। শুধু মায়া নয়, এলাকার ঐতিহ্য নিয়েও গর্ব রয়েছে। ইদানীং ছোটখাটো বদলেও মনটা খারাপ হয়ে যায়। পাড়াকে খুব ভালবাসি বলেই হয়তো বা।
লেখক বিশিষ্ট শিশু-চিকিৎসক