আমাকে বাঁচান, চিরকুটের আর্তিতে উদ্ধার ‘বন্দিনী’

মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকেই লুকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের রাস্তায় কাগজের টুকরো ছুড়তেন তিনি। তাতে লেখা থাকত, যে ভাবে হোক তাঁকে উদ্ধার করুক কেউ। এমনই একটি কাগজের টুকরোকে সম্বল করে তাঁর বোন যোগাযোগ করেছিলেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে। সেই সংস্থার কর্মীরাই হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে আনলেন ওই ‘বন্দিনী’ মহিলাকে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:২১
Share:

মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকেই লুকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের রাস্তায় কাগজের টুকরো ছুড়তেন তিনি। তাতে লেখা থাকত, যে ভাবে হোক তাঁকে উদ্ধার করুক কেউ। এমনই একটি কাগজের টুকরোকে সম্বল করে তাঁর বোন যোগাযোগ করেছিলেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে। সেই সংস্থার কর্মীরাই হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে আনলেন ওই ‘বন্দিনী’ মহিলাকে। জানা গিয়েছে, এক সরকারি চিকিৎসকের সুপারিশের ভিত্তিতেই ওই বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল ‘সম্পূর্ণ সুস্থ’ সেই ৩৭ বছরের মহিলাকে। এক বারও না-দেখে ওই চিকিৎসক তাঁকে ‘মানসিক রোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেন বলে অভিযোগ।

Advertisement

মহিলার লিখিত বয়ানের ভিত্তিতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও পাভলভ মানসিক হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের ওই চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে বিভাগীয় তদন্ত। ন্যাশনালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান তৃষিত ঘোষ বলেন, ‘‘অভিযোগটা মারাত্মক। আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করছি।’’ পাভলভ কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন, অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরাও অস্বস্তিতে রয়েছেন।

শম্পা দাস (নাম পরিবর্তিত) নামে ওই মহিলার অভিযোগ, শ্বশুরবাড়ির নির্দেশেই তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল সেখানকার পাঁচ জন কর্মী। ওই হাসপাতালে তাঁর উপরে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল না বাইরের কারও। ২৬ জুলাই থেকে ২ অগস্ট পর্যন্ত সেখানে ভর্তি ছিলেন শম্পা। হাসপাতালে একাধিক বার গিয়েও দিদির দেখা পাননি তাঁর বোন। শেষ পর্যন্ত ওই মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে দিদির ছোড়া কাগজের টুকরো নিয়ে কোনও রকমে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। ওই সংস্থা এবং মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা আর একটি সংস্থার কর্মীরা যৌথ ভাবে হাসপাতালে গিয়ে উদ্ধার করেন ওই মহিলাকে।

Advertisement

রোগিণীকে যথাযথ ভাবে পরীক্ষা না-করেই ভর্তির সুপারিশ করা যে তাঁর পক্ষে বড় ভুল হয়েছিল, সে কথা স্বীকার করেছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘কিছু ভুল হয়েছিল। তবে আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। এর বেশি একটা কথাও বলতে পারব না।’’

পারিবারিক অশান্তির জেরে স্ত্রীকে ‘পাগল’ সাজানোর এমন অভিযোগ তাদের কাছে অজস্র আসছে বলে জানিয়েছে রাজ্য মহিলা কমিশন। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি মানসিক হাসপাতালেও এমন হয়। পাভলভ, লুম্বিনী পার্ক, বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে আমি একাধিক বার গিয়েছি। সেখানেও অনেককে দেখেছি, যাঁদের পরিবারের লোকেরাই পাগল সাজিয়ে ভর্তি করে রেখেছে। অথচ, তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা ঠেকাতে সব স্তরেই নজরদারি দরকার। আমরা কমিশনের তরফেও এ নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছি।’’ এক জন মহিলাকে পরীক্ষা না-করেই তাঁকে ‘পাগল’ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি করার এই ঘটনা হিমশৈলের চূড়ামাত্র বলে মনে করছেন মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের কর্মীরা। মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘এমন ঘটনা আকছার ঘটে। বেসরকারি মনোরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রগুলির উপরে সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা উচিত।’’

১৯ বছর আগে আন্দুলের রায়পাড়ার পবিত্র দাসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল শম্পা দাসের (নাম পরিবর্তিত)। তাঁদের একটি ছেলেও রয়েছে। শম্পাদেবীর অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরেই তাঁর উপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছেন পরিবারের লোকেরা। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগও করেছেন তিনি। তাঁর স্বামী বেশ কয়েক বছর আলাদা থাকেন। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে আইনগত সাহায্য দেয়, হাসপাতাল থেকে চিরকুট ছুড়ে তাদের কাছেই সাহায্য চান তিনি। সংস্থার তরফে অনুরাধা কপূর বলেন, ‘‘ওই মহিলা আমাদের সংগঠনের নানা সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। কখনও মানসিক অসুস্থতা দেখিনি। যে ভাবে স্রেফ এক জন ডাক্তারকে প্রভাবিত করে ওঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হল, তা প্রমাণ করে দেয়, আমাদের যে কারও জীবনে এটা ঘটতে পারে।’’ আর শম্পাদেবীর বক্তব্য, ‘‘আমাকে পাগল প্রমাণ করতে পারলে বিবাহ-বিচ্ছেদ পেতে সুবিধা হবে। তাই এটা করা হয়েছে। আমি যে জীবিত অবস্থায় ওখান থেকে ফিরতে পেরেছি, সেটাই অনেক।’’

অন্য দিকে, পবিত্র দাসের দাবি, তাঁর স্ত্রী বিয়ের পর থেকেই মানসিক রোগে ভুগছেন। তাই হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে উপায় ছিল না। ১৯ বছর ধরে যাঁর মানসিক সমস্যা, তাঁকে এত দিন কেন ডাক্তার দেখানো হল না? পবিত্রবাবুর জবাব, ‘‘দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ওই সব প্রেসক্রিপশন ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।’’ এলাকার মানুষ বা আত্মীয়-স্বজন কেউই তো তাঁর স্ত্রীকে মানসিক রোগী হিসেবে মানছেন না। কেউ এত বছর মানসিক রোগে ভুগলে, সে কথা তাঁরা জানতে পারতেন না? তিনি বলেন, ‘‘এত শত প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না।’’

মধ্যমগ্রামের দোলতলার ওই বেসরকারি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে এর আগেও এমন নানা অভিযোগ উঠেছে। কেন তারা যথোপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কাউকে মনোরোগী হিসেবে ভর্তি করলেন? হাসপাতালের তরফে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা যদি কাউকে রোগী বলে চিহ্নিত করেন, তা হলে আমরা আর কী বলব? এ রকম ঝঞ্ঝাট চলতে থাকলে হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে।’’

অঙ্কন: অশোক মল্লিক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement