ভিন্ রাজ্যে থাকা মেয়েকে ফোন করছিলেন কসবার রাজা মজুমদার। এক মিনিটও হয়নি, হঠাৎই লাইন কেটে গেল। ফের ফোন করলেন এবং মিনিট পেরোনোর আগেই আবার এক ঘটনা! পুরো কথা শেষ করতে অন্তত পাঁচ বার ফোন করতে হল তাঁকে।
শুধু তিনিই নন, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের সকলের অভিজ্ঞতাই কমবেশি এ রকম। কেউ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন, হঠাৎই ফোনের লাইন কেটে গেল। পরক্ষণেই ফোন করতে উল্টো দিক থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, ‘‘নট রিচেবল।’’ কেউ বা একই এসএমএস পেলেন পরপর পাঁচ বার! কেউ আবার রবিবার বন্ধুর পাঠানো আমন্ত্রণের বার্তা পেলেন সোমবার। এমনকী, শহরেরই এক জনকে ফোন করতে গিয়ে বারবার ভিন্ রাজ্যে ফোন চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
চলতি শতকের গোড়ায় টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল মোবাইল ফোন। যার দাপটে এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে গেরস্থ বাড়ির চেনা ল্যান্ডফোন। কিন্তু নানা বিভ্রাটে এখন সেই মোবাইল ফোনও যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠছে। শহরের বাসিন্দা এক প্রৌঢ় যেমন বলছেন, ‘‘ল্যান্ডফোনের বিভ্রাট নিয়ে কমেডি-নাটক হয়েছিল। এখন মোবাইলেরও একই দশা!’’ অনেক গ্রাহকই কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে বারংবার অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁদের অবশ্য বারবার শুনতে হচ্ছে একই কথা, ‘‘সিস্টেম ‘আপগ্রেড’ করা হচ্ছে।’’
ঘটনাটা আসলে কী?
টেলিকম সংস্থার কর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কিন্তু এত সংখ্যক গ্রাহককে সুষ্ঠু পরিষেবা দিতে পর্যাপ্ত টাওয়ার ও পরিকাঠামো নেই সংস্থাগুলির। গ্রাহক সংখ্যা বাড়িয়ে সংস্থাগুলি নিজেদের ব্যবসার বহর বাড়াচ্ছে। তা হলে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি কেন?
বিএসএনএলের এক কর্তা জানান, বছর দুয়েক আগে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রক মোবাইল টাওয়ারের কম্পাঙ্ক আগের থেকে নব্বই শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিল। কম্পাঙ্ক কমানোর ফলে সুষ্ঠু পরিষেবা দিতে টাওয়ারের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। ‘‘কিন্তু বহু জায়গাতেই টাওয়ার বসানো নিয়ে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। তাঁদের আপত্তিতেই টাওয়ারের সংখ্যা বাড়ানো যায়নি,’’ দাবি ওই টেলিকম কর্তার। একই সঙ্গে তিনি জানান, পরিকাঠামো গড়ার টাকাও দীর্ঘ দিন সরকারি ফাঁসে আটকেছিল।
টাওয়ারের অভাব নিয়ে একই সুর বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলিরও। তাদের একটি সূত্র বলছে, প্রত্যেকটি টাওয়ারের একটি নির্দিষ্ট এলাকা থাকে। টাওয়ারগুলি এমন ভাবে বসানো হয়, যাতে একটি টাওয়ারের এলাকার সঙ্গে আর একটির এলাকা জুড়ে থাকে। কিন্তু এখন দু’টি টাওয়ারের মধ্যে বেশ কিছুটা এলাকা ফাঁকা থাকছে।
এই সমস্যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক টেলিকম কর্তা বলছেন, টেলিকম ব্যবস্থায় টু-জি ও থ্রি-জি প্রযুক্তি একসঙ্গে চালু থাকার ফলেও ‘কল ড্রপ’ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই চলন্ত গাড়িতে বা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার সময়ে ফোন কেটে যায়। তার কারণ, চলন্ত অবস্থায় ক্রমাগত ফোনের টাওয়ার বদলাতে থাকে। ফোনের সংযোগ থ্রি-জি টাওয়ার থেকে টু-জি কিংবা টু-জি থেকে থ্রি-জি টাওয়ারে পরিবর্তিত হলেই ফোন কেটে যায়।
কিন্তু টেলিকম সংস্থাগুলির নিজেদের এই প্রযুক্তিগত সমস্যায় গ্রাহকদের কিন্তু খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সেটার কী হবে?
টেলিকম সংস্থাগুলির সংগঠন সেলুলার অপারেটর্স অব ইন্ডিয়া (সিওএআই)-র দাবি, এই ঘটনায় টেলিকম সংস্থাগুলি আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে, এমন ভাবার কারণ নেই। কেন? তাদের দাবি, মাসুলে ছাড়ের সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রায় সব গ্রাহকই বিশেষ ‘ভাউচার’ ব্যবহার করেন। সেই মাসুল হার প্রতি সেকেন্ড-এর হিসেবে কষা হয়। তার ফলে একটি কলে যত সেকেন্ড সময় লেগেছে, সেই হারেই পয়সা নেওয়া হয়। তাই কল ড্রপ করলেই গ্রাহককে খুব একটা বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে, এমনটা নয় বলেই তাঁদের দাবি।
কিন্তু যে সব ফোনের মাসুলের হার সেকেন্ডের হিসেবে করা নেই, তাদের কল ড্রপ করলে বাড়তি খরচ দিতে হবে। কী ভাবে? টেলিফোন কর্তারা জানিয়েছেন, কল চার্জ নির্ভর করে পাল্স রেটের উপরে। পাল্স রেট ১ মিনিটের হলে, ১ মিনিট ৪ সেকেন্ড কথা বললে গ্রাহককে দাম দিতে হবে দু’টি কলের। তাই পাল্স রেট যত কম হবে, ততই গ্রাহকের লাভ। অর্থাৎ, পালস রেট ১ সেকেন্ড হলে ওই ১ মিনিট ৪ সেকেন্ড কলের জন্য গ্রাহককে দু’টি কলের বা ১২০ সেকেন্ডের বদলে দিতে হবে ৬৪ সেকেন্ড কলের দাম। কিন্তু সব সার্ভিস প্রোভাইডার সেকেন্ডে পাল্স রেট রাখে না। গ্রাহকদের অভিযোগ, বহু সার্ভিস প্রোভাইডারই পাল্স রেট বাড়িয়ে ১ মিনিট করে রেখেছে। তাদের ক্ষেত্রে কল ড্রপ করলে গ্রাহকদের ক্ষতি বাড়বে। বিভিন্ন টেলিকম সংস্থার ভাউচারে ১৫ সেকেন্ড বা ১০ সেকেন্ডেরও ‘পাল্স রেট’ রয়েছে। সে সব ক্ষেত্রেও একটা ফোনের পিছনে গ্রাহকদের বাড়তি খরচ বইতে হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এই সমস্যা থেকে কবে রেহাই পাবেন গ্রাহকেরা?
ভোডাফোন, এয়ারটেলের মতো বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলি এ ব্যাপারে কিছু জানাতে চায়নি। তবে বিএসএনএল কর্তাদের একাংশ বলছেন, টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং টু-জি প্রযুক্তি থেকে পুরোপুরি থ্রি-জি প্রযুক্তিতে উন্নীত না হলে এই সমস্যা চলতেই থাকবে। কিন্তু সেই দাওয়াই মিলবে কবে?
সদুত্তর মেলেনি কারও কাছেই।