Buddhadeb Bhattacharjee Death

স্কুলে এলেও বসতে রাজি হননি হেডস্যরের চেয়ারে

বৃহস্পতিবার দুপুরে এ সব পুরনো গল্পেই উত্তর কলকাতার শতাব্দী-প্রাচীন স্কুলবাড়ি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। ১৯৯৭-এ স্কুলের উঠোনে জ্যোতির্বিকাশের আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করেন বুদ্ধদেব।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৪৭
Share:

উত্তর কলকাতার শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকেরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন প্রাক্তন ছাত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবিতে। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুমন বল্লভ

সাবেক বাড়ির প্রকাণ্ড ঘরটায় ইংরেজির ফার্স্ট বুক-খ্যাত প্যারীচরণ সরকার এবং তাঁর পুত্র, শিক্ষাবিদ শৈলেন্দ্র সরকারের মানুষ-সমান তৈলচিত্র। শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের ঘরে কোণের একটি চেয়ার দেখিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হরিনাথ নন্দ বললেন, ‘‘বুদ্ধবাবু স্কুলে এসে এখানটায় বসেছিলেন। আমরা হেডস্যরের চেয়ারেই বসাচ্ছিলাম। কিন্তু উনি অনড়! অসম্ভব, স্যরের চেয়ারে বসব না!’’

Advertisement

স্যর মানে শৈলেন্দ্র ইস্কুলের প্রাণপুরুষ জ্যোতির্বিকাশ মিত্র। একাদশ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসে যে স্যরের কাছে ‘আইভ্যানহো’ পাঠ নিয়ে বুড়ো বয়সেও সহপাঠীদের আড্ডায় উদ্বেল হতেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জ্যোতির্বিকাশ কিন্তু গোঁড়া কংগ্রেসি। তাঁর এবং বুদ্ধদেবের বাবা নেপালচন্দ্রের মধ্যে বই বিনিময় চলত। বইবাহক বালক বুদ্ধদেব ওরফে বাচ্চু।

বৃহস্পতিবার দুপুরে এ সব পুরনো গল্পেই উত্তর কলকাতার শতাব্দী-প্রাচীন স্কুলবাড়ি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। ১৯৯৭-এ স্কুলের উঠোনে জ্যোতির্বিকাশের আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করেন বুদ্ধদেব। ২০০১-এ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের জন্য টাউন স্কুলের গলি পর্যন্ত লাল গালচে পাতা হয়েছিল। হেঁটে আসেন বুদ্ধদেব। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, ‘‘অনুষ্ঠানে ঘোষণা করার সময়ে আমি একটু আলঙ্কারিক ভাষার ব্যবহার করছিলাম। উনি আমার কানে কানে বললেন, ছোট করে বলুন দেখি! খুব শক্ত কিন্তু!’’ শ্যামপুকুর পাড়ার ‘গরিবের ডাক্তার’ গণেশ বেদজ্ঞ কোথায়, জিজ্ঞাসা করে বুদ্ধবাবু তাঁকে মঞ্চে পাশে বসান। তখন জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক অরবিন্দ কুণ্ডু স্কুলে বুদ্ধবাবুর এক বছরের সিনিয়র। তাঁর কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে আড়ালে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সুখটান দিয়েছিলেন। স্কুলের হেডস্যরের ঘরে বসে ধূমপান করতে চাননি।

Advertisement

শৈলেন্দ্র ইস্কুলের অদূরে ১১ডি রামধন মিত্র লেনে বুদ্ধদেবের পারিবারিক বাড়িটাও এলাকাবাসীর মুখস্থ। তেতলার রং হওয়া জানলাটা দেখিয়ে প্রতিবেশী গৌর ভদ্র চেনালেন, ‘‘ওখানেই বাচ্চু থাকত।’’ গৌরবাবু পাড়ার আর এক কিংবদন্তী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভাইপো। ভট্টাচার্য পরিবারের কেউ থাকেন না অনেক দিন। বাড়িওয়ালা রং করানোর পরে নতুন ভাড়াটে আসেননি। তবে পাশের বাড়ির শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘বছর ৩০ আগে কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে এক বার বুদ্ধবাবু এসেছিলেন।’’

গৌর ভদ্র বুদ্ধদেবের ‘পাড়ার দাদা’। বললেন, ‘‘আমার ডিরেকশনে বাচ্চু নাটকও করেছে। রবীন্দ্রনাথ অবলম্বনে মাস্টারমশায়-এর নাট্যরূপ দিয়ে মেন রোল করেছিল। আর বাম রাজনীতির নাটক ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’রও দারুণ ভাবানুবাদ করে।’’

বুদ্ধদেবের সহপাঠী তথা স্কুলের আর এক প্রাক্তন শিক্ষক তপন ভট্টাচার্যের সঙ্গেও স্কুলের শিক্ষকদের বার বার ফোনে কথা হচ্ছিল। আকাশবাণীর বাণীকুমারের পুত্র তপন এবং বুদ্ধদেব ১৯৬১-র ব্যাচের উচ্চ মাধ্যমিক। টকি শো হাউস, লাইটহাউসে বুদ্ধদেবের সঙ্গে ক্লার্ক গেবলের সিনেমা দেখা থেকে শ্যামপার্কে ক্রিকেটের নানা স্মৃতিতে মশগুল তপন। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের সামান্য জুনিয়র অম্বর রায়ের সঙ্গে বুদ্ধও স্কুল টিমে খেলত। শেষ বার সল্টলেকে এক বন্ধুর বাড়িতে আমাদের আড্ডা বসে ২০০৩-এ। দেখা হত না, তবে মনের দিক থেকে আমাদের বন্ধুদের এক ফোঁটা দূরত্ব ছিল না!’’

১৯৬৯-’৭১ বুদ্ধদেবের কর্মস্থল দমদমের শেঠবাগান আদর্শ বিদ্যামন্দিরের সহকর্মী, ভৌতবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুকুমার কুণ্ডু বলছিলেন, ‘‘নকশাল আমলের হুমকির জেরেই উনি চাকরি ছাড়েন। তবে ২০০০ সালে স্কুলের ৫০ বছরে মহাকরণে আমাদের অনেকটা সময় দিয়েছিলেন। তখনও একই রকম মাটিতে পা-রাখা মানুষ।’’

আজ, শুক্রবার শৈলেন্দ্র স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement