পুর-নির্বাচনে বিজেপি-র ‘বিপদ’ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে সতর্কতার কথা শুনিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। এ বার পুর-অধিবেশনের আলোচনাতেও ঘুরে ফিরে সামনে চলে আসছে বিজেপি। কখনও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভূমিকা, কখনও বা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী, এই রাজ্যের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে রাজ্য সরকারের দেখা করতে না-চাওয়া এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে বৃহস্পতিবার দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল পুর-অধিবেশন। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বললেন, “উনি তো হাফ-মন্ত্রী। এখনও দফতরের সিঁড়ি চেনেন না।” পরে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তৃণমূলের সৌগত রায় তো দীর্ঘ সময় নগরোন্নয়ন দফতরেরই প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মেয়র বললেন, “ও সব ছাড়ুন তো।”
ঘটনার সূত্রপাত এ দিন পুর-অধিবেশনে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে বিজেপি সরকার কলকাতার জন্য বরাদ্দ অর্থ দিচ্ছে না তৃণমূলের তোলা ওই অভিযোগকে কেন্দ্র করে তুলকালাম হল পুর-অধিবেশন। বিজেপি-র দুই কাউন্সিলর ওই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলতে থাকেন কেন্দ্র মুখ ফেরালে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় রাজ্যের মন্ত্রী ও অফিসারদের সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না। বরং রাজ্যের মন্ত্রী-আমলারা দেখা না করে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন।
বিজেপি-র ওই বক্তব্য শুনেই সতীর্থ কাউন্সিলরকে সরিয়ে মাইক হাতে নেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা শহরের উন্নয়নে বিজেপি রাজনীতি করছে বলে অভিযোগ করে মেয়র কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানান। একই সঙ্গে ৩৪ বছরের বাম সরকারের অকর্মণ্যতার প্রসঙ্গও তোলেন। আর তা শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাম কাউন্সিলরেরা। মেয়রের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে অধিবেশন বয়কট করেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই মেয়র তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী সিপিএমের রূপা বাগচির অভিযোগ, “নির্বাচনী বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মেয়র এ দিন অধিবেশনকক্ষ ব্যবহার করেছেন। তার প্রতিবাদ করতেই আমরা ওয়াক আউট করেছি।” মেয়র শোভনবাবু অবশ্য বলেন, “কী বলতে চাইছি তা শোনার ধৈর্য ওঁদের ছিল না। হয়তো বুঝতে পারেননি। তাই বেরিয়ে গিয়েছেন।”
এ দিন বেলা একটায় অধিবেশন শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রথম বিতর্ক বাধে ধাপার জলপ্রকল্প গড়ার দাবিদার কে তা নিয়ে। ওই প্রকল্প আগামী ডিসেম্বরে শুরু হবে বলে পুর সূত্রের খবর। সিপিএমের চন্দনা ঘোষ দস্তিদারের প্রশ্ন ছিল, কবে ওই প্রকল্প শুরু হয়েছিল এবং কবে থেকে জল সরবরাহ শুরু হবে ইত্যাদি। মেয়র তার উত্তর দেওয়র সময় হঠাত্ই কংগ্রেসের প্রকাশ উপাধ্যায় বলে ওঠেন “ওই প্রকল্পের বাবা কে? বিকাশবাবু না শোভনবাবু?” তা শুনেই হইচই করে ওঠেন তৃণমূল কাউন্সিলরেরা। বেধে যায় তর্ক-বিতর্ক। যা আরও চড়া হয় মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্যকে ঘিরে। ‘দায়বদ্ধ’ নাটকের প্রসঙ্গ তুলে মেয়র বলেন, পালক পিতা না জন্মদাতা, কে আসল?” যা শুনে সিপিএমের কাউন্সিলরেরা চিত্কার শুরু করেন। এক বাম কাউন্সিলরের কথায়, “শোভনের মুখে ওই অশোভন বক্তব্য ভাল লাগেনি।” পরে অবশ্য মেয়র বলেন, তাঁর কথায় কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে তিনি দুঃখিত।
দ্বিতীয় দফার বচসা শুরু হয় অধিবেশনের শেষ পর্বে। পুরসভার অ্যাজেন্ডা পাশ করার সময়ে ১১ নম্বর অ্যাজেন্ডার বিষয় নিয়ে বলতে ওঠেন তৃণমূলের কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান তারকেশ্বর চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য ছিল, কলকাতা শহরকে ভ্যাট-মুক্ত করতে উদোগী হয়েছে পুরসভা। জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের আওতায় ওই প্রকল্প অনুমোদন করা হলেও বর্তমান বিজেপি সরকার টাকা না দেওয়ায় আটকে গিয়েছে প্রকল্পের কাজ। তখনই বিজেপি-র কাউন্সিলর মীনাদেবী পুরোহিত বলে ওঠেন, “সাহায্যের হাত নিয়ে কেন্দ্রের নতুন মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় রাজ্যের পুরমন্ত্রী ও অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আপনারাই তো কথা বলার সৌজন্যটুকু দেখাননি।” যা শুনে ফের একবার হইচই শুরু করেন তৃণমূলের কাউন্সিলরেরা। এর পরেই মেয়র আসন থেকে মাইকের সামনে এসে বলতে থাকেন, “এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নামে থাকা প্রকল্প বাতিল করেছে বর্তমান বিজেপি সরকার। পুরসভার পাঠানো প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল কংগ্রেস সরকারের আমলে। এখন তা বাতিল করা হবে কেন? সরকার বদলাতে পারে কিন্তু অনুমোদিত প্রকল্প বাতিল হবে কেন। এ প্রসঙ্গে বামেদের ৩৪ বছরের কথাও তুলে ধরে তিনি বলেন, ওঁরা তো ভ্যাট-মুক্ত করার ব্যাপারে কিছু করেননি। এঁদের অনেক প্রকল্প আমরা এসে করছি।” এ সব শুনেই ফের হট্টগোল শুরু করেন বাম কাউন্সিলরেরা। এক সময়ে তাঁরা কক্ষ ত্যাগ করেন। রূপাদেবীর অভিযোগ, “কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজে সকলের সাহায্য থাকলেও তৃণমূল শুধু নিজেদের প্রচার করতে অধিবেশন কক্ষ ব্যবহার করেছে।”