প্রতিবাদ: বিক্রম তখন টালিগঞ্জ থানার ভিতরে। বাইরে কংগ্রেসের বিক্ষোভ, মদমুক্ত বাংলার দাবিতে। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
টেলি-পাড়ায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে ভাব-ভালবাসা আছে। আবার গোপন রেষারেষিও আছে। কিন্তু আপাত সহিষ্ণুতার চাদরে মোড়া থাকত এর বেশির ভাগটাই। একটা মৃত্যু রাতারাতি তার মধ্যে একটা বিভাজনরেখা তৈরি করে দিল।
অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের গাড়ি দুর্ঘটনা এবং তাতে মডেল সোনিকা সিংহ চৌহানের মৃত্যু অঘোষিত যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে বাংলা টেলি-ধারাবাহিকের জগতে। ঠিক যে ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্রম এবং সোনিকার পক্ষে তৈরি হয়েছে দুটো আলাদা গোষ্ঠী, ঠিক সে ভাবেই টালিগঞ্জ পাড়াতেও এখন দুটো ভাগ। বিক্রমপন্থী এবং বিক্রম-বিরোধী। প্রকাশ্যে তো অনেকে মুখ খুলছেনই, আবার শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকেও এ নিয়ে চলছে ফিসফিস আলোচনা। এমনকী, মঙ্গলবার বিক্রম নিজে যখন শ্যুটিংয়ে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর আড়ালে-আবডালেও চলেছে এ নিয়ে আলোচনা, যাতে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন ইউনিটের অনেকেই।
সোনিকার মৃত্যুকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। এক দিকে তৈরি হয়েছে ‘জাস্টিস ফর সোনিকা’, অন্য দিকে ‘ভয়েস ফর বিক্রম’ গ্রুপ। দুই গ্রুপ থেকেই অনলাইন পিটিশন জমা দেওয়া হচ্ছে। সোনিকার বন্ধুরা মুখ্যমন্ত্রী, কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং জাতীয় মহিলা কমিশনে পিটিশন জমা দিয়েছেন। বিক্রমপন্থীরা জমা দিয়েছেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে।
আরও পড়ুন: বিক্রম-সোনিকা আমার বন্ধু, তবু আজ আমি মুখ খুলছি
টালিগঞ্জের অভিনেতা-কলাকুশলীদের বাগযুদ্ধে এক পক্ষের যুক্তি, ২৯ এপ্রিল ভোরে লেক মলের সামনে যা হয়েছে, সেটি নিছক দুর্ঘটনা। বিক্রমের কোনও অপরাধ নেই। যেমন মনে করছেন অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘বিক্রম এক বারও বলেনি যে ও মদ্যপান করেনি। ও বলেছিল, ও মাতাল ছিল না। আমি যত দূর জানি, সোনিকা খুব দায়িত্বশীল মেয়ে ছিল। বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য গভীর রাতে ও যখন বিক্রমকেই বেছে নিয়েছিল, তখন এটা ধরে নেওয়াই যায় যে, বিক্রমও নিশ্চয়ই যথেষ্ট দায়িত্বশীল।’’
অন্য দিকে, সোনিকার বন্ধু, মডেল বিদিতা বাগের মন্তব্য, ‘‘কোনও সন্দেহই নেই যে, বিক্রম আগাগাোড়া সত্য গোপন করছেন। নিশ্চয়ই সেই রাতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চলছিল। তাই দুর্ঘটনা ঘটে। এটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় হতে পারে না।’’
দুর্ঘটনার আগের রাতে ভবানীপুরের ক্লাবের পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন সোনিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অভিনেতা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। পুলিশ তাঁর বয়ান রেকর্ড করেছে। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্রমের মদ খেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং ট্র্যাফিক আইন ভাঙার দিকেই বারবার আঙুল তুলেছেন অনিন্দ্য। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘কী ভাবে কী হয়েছে, সেটা এখন কাচের মতো স্বচ্ছ। সবাই সব বুঝতে পারছে। পুলিশের কাছে বয়ান দিয়েছি, তাই দুর্ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। সেটা তদন্তে সমস্যা তৈরি করতে পারে।’’
এরই মধ্যে আবার অনিন্দ্যের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিক্রমের চলতি ধারাবাহিক ‘ইচ্ছেনদী’র সহ-অভিনেত্রী সোলাঙ্কি রায়। তিনি বলেন, ‘‘কে কী মন্তব্য করছেন, সেটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে, ঘটনার পরের দিন সকাল সাতটা থেকে হাসপাতালে ছিলাম। পুলিশ আমাদের হাতে সোনিকার ফোন দেয়। কিন্তু সেটায় পাসওয়ার্ড দেওয়া ছিল। তাই সোনিকার পরিবারকে দুর্ঘটনার বিষয়ে জানানোর জন্য অনিন্দ্যকে বারবার ফোন করি। কারণ, আমাদের কাছে সোনিকার বাবা-মায়ের নম্বর ছিল না। আমরা সোনিকাকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। অনিন্দ্য চিনত। কিন্তু ও কোনও রকম সহযোগিতা করেনি। ফোন ধরেনি। এমনকী কল-ব্যাকও করেনি। এর থেকেই বোঝা যায়, কে কী চাইছে।’’ বিক্রম সম্পর্কে সোলাঙ্কির বক্তব্য, বিক্রম অত্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে, ট্র্যাফিক আইন মেনেই গাড়ি চালায়। তাই এটা নিছক দুর্ঘটনা।
অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য বলেন, ‘‘সোনিকা খুব মিষ্টি মেয়ে। সাহেব আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। সুন্দর করে কথা বলেছিল। কিন্তু আমি তো বিক্রমকেও ভালবাসি। ও খুব ভাল মানুষ। আর গত কাল আমি তো নিজেই রাতে গোলপার্ক থেকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে রামকৃষ্ণ মিশনের উল্টো দিকে একটা ট্যাক্সির সঙ্গে দুর্ঘটনা হতে হতে বেঁচে যাই। সেই মুহূর্তে আমার বিক্রমের কথাই মনে পড়ছিল। ও তো ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায়নি। বেঁচে আছে বলে ওকে নিয়ে এত কাটাছেঁড়া না করে, যাদের যা কাজ তা-ই করুক।’’