বড়তলা থানায় বেআইনি অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ভূষণ দেশমুখের মৃত্যু পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন পেটের গোলমাল কিংবা বমির কারণে হয়নি। বরং পুলিশি হেফাজতে মারধর এবং অকথ্য অত্যাচারের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পুলিশ হেফাজতে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের ফলেই ভূষণের মৃত্যু হয়েছে। ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি টেস্টের পরেই আরও বিস্তারিত কারণ জানানো যাবে।
কী ভাবে এই মামলায় জড়াল ভূষণ? পুলিশ সূত্রে খবর, গত ২০ সেপ্টেম্বর বড়তলা থানার পুলিশ দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট থেকে গ্রেফতার হয় ভূষণ। ওই দিন আদালতে হাজির করানো হলে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু সেই হেফাজত শেষ হওয়ার আগেই ২৫ তারিখ রাতে সে আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আরজিকর হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করে। সেখানেই চিকিৎসা চলাকালীন তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনার পরে পুলিশ পেটের অসুখে অসুস্থতার কারণে ভূষণের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের লোকজনকে জানায়। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই তার পরিবারের লোকজনের মতামত ছিল অন্যরকম। তাঁদের দাবি, মৃত্যুর আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিকেলেও ভূষণের সঙ্গে তাঁদের ফোনে কথা হয়েছে। থানার এক অফিসারই কথা বলিয়েছিলেন। তখনও পর্যন্ত ভূষণ নিজে কিংবা থানা থেকে কেউ তার অসুস্থতার কোনও কথা জানায়নি। ভূষণের সঙ্গে কথা বলেও তাকে অসুস্থও মনে হয়নি পরিবারের লোকজনদের। তা সত্ত্বেও এক দিনের মধ্যেই কী এমন ঘটল যে হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পরেই ভূষণের মৃত্যু হল তা ভাবাচ্ছে ওই যুবকের পরিবারের। ভূষণের পরিবারে সেই অভিযোগ যে সত্য তার প্রমাণ মিলল খোদ হাসপাতালের চিকিৎসকদের ময়না তদন্তের রিপোর্টেও।
পুলিশ আরও জানিয়েছিল, সিঁথি থানা এলাকার শম্ভু দাস লেনে কয়েক বছর ধরে কাজ করলেও আদতে সে মহারাষ্ট্রের সাতারার রহিমপুরের বাসিন্দা। মহারাষ্ট্রের আর এক বাসিন্দা অনিল পাতিল শম্ভু দাস লেনে নিজের দোকানে স্বর্ণ কারিগর হিসাবে তাকে কাজ দিয়েছিল। আর এই কাজের সূত্রেই সে ওখানে থাকত। সম্প্রতি বড়তলা থানার সোনাগাছি এলাকাতে গুলি চলেছিল। সেই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়েই ভূষণ-সহ আরও দু’জন ধরা পড়ে পুলিশের জালে।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ভূষণ জামিন না পেলেও পুলিশ কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই মামলার প্রয়োজনে তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রেখে জেরা চালাতে থাকে পুলিশ। তাকে ফের ২৯ সেপ্টেম্বর ফের আদালতে হাজির করানোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় পুলিশকে। সেখানে মৃত্যুর পর দেহ পাঠানো হয় ময়না তদন্তে। এর পর পরিবারের লোকজনকে ডেকে দেহ পরিবারের লোকজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
২০ সেপ্টেম্বর থেকে ভূষণ ছিলেন পুলিশ হেফাজতে। লালবাজারের একাংশের পুলিশ কর্তারা জানাচ্ছেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই স্পষ্ট, মরাঠী ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে পুলিশ হেফাজতে, মারধরের কারণেই। যার প্রাথমিক দায় গিয়ে বর্তায় ঘটনার সময়ে লক-আপের দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মী এবং তদন্তকারী অফিসারের উপরে। অথচ, সরকারি ভাবে এখনও লালবাজারের তরফে থানার লক-আপে মারধরের কারণেই যে ভূষণের মৃত্যু হয়েছে, তা কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে। বরং, লালবাজারের দাবি, মৃত্যু হয়েছে ভূষণের নিজস্ব অসুস্থতার কারণেই। ঘটনার তদন্তের গতিপ্রকৃতিতেও লালবাজারের এই দাবির সমর্থন মিলেছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট মারধরের কারণে মৃত্যুর কথা উল্লেখ থাকলেও ঘটনায় অভিযুক্ত অফিসারের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা (৩০৪ ধারা) দায়ের করেছে লালবাজার। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওই থানারই আর এক অফিসারকে।