ফাইল চিত্র।
আদৌ খুন হননি বাঁশদ্রোণীর নিরঞ্জনপল্লির বাসিন্দা, বছর ৪৮-এর দেবাশিস চক্রবর্তী। থানায় গিয়ে দাদাকে খুনের মিথ্যা দাবি করেছিলেন দেবাশিসের ভাই শুভাশিস। তদন্তের পরে বৃহস্পতিবার এই কথাই জানিয়েছে পুলিশ। সেই সঙ্গে তাদের দাবি, দাদাকে খুনের পুরোটাই কল্পনা করেছেন বছর পঁয়তাল্লিশের শুভাশিস। থানায় গিয়ে খুনের দাবি করার সময়েও তিনি মত্ত অবস্থায় ছিলেন বলে পুলিশের দাবি। এক তদন্তকারীর মন্তব্য, ‘‘দাদার মৃত্যুকে ব্যবহার করে আসলে নিজের একটা বন্দোবস্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন ওই ব্যক্তি।’’
মঙ্গলবার রাত দেড়টা নাগাদ বাঁশদ্রোণী থানায় গিয়ে শুভাশিস দাবি করেন, তিনি তাঁর দাদাকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছেন। প্রথমে সে কথায় আমল না দেওয়ার কথা ভাবলেও পরে শুভাশিসদের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে পুলিশ দেখে, বিছানায় পড়ে শুভাশিসের দাদা দেবাশিসের দেহ! পাশের একটি বাটিতে জল। মৃতদেহের মাথায় জলপট্টির মতো করে রাখা ভিজে কাপড়। কিন্তু তদন্তকারীদের সন্দেহ হয়, বালিশ চাপা দিলে বাঁচার চেষ্টা করার কোনও ছাপ ঘটনাস্থলে থাকত। কিন্তু তা ছিল না। শুভাশিসকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর পাশাপাশি ময়না-তদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষা করা হয়।
তবে শুভাশিস টানা দাবি করে যান যে, এক সময়ে মায়ের পেনশনের ৩৫ হাজার টাকায় তাঁদের সংসার চলত। কিন্তু ১৬ মে মায়ের মৃত্যুর পরে সেই পেনশন বন্ধ হয়ে যায়। চোখের সমস্যার কারণে দাদা দেবাশিসও চাকরি থেকে অবসর নেন। সেই সূত্রে মাসিক ১৫ হাজার টাকা করে পেতেন দেবাশিস। তবু দু’জনের সংসারে অনটন শুরু হয়। ফলে ভাল ফ্ল্যাট ছেড়ে কম টাকার বেড়ার ঘরে ভাড়া আসেন দুই ভাই। কিন্তু তাতেও আর্থিক কষ্ট ঘোচেনি। এর মধ্যেই গত চার-পাঁচ দিন ধরে বমি, পেটের সমস্যা, জ্বরে ভুগছিলেন দেবাশিস। কিন্তু টাকার অভাবে দাদার চিকিৎসা করাতে না পেরে শুভাশিস অবসাদে ভুগছিলেন। সেই থেকেই তিনি দাদাকে খুন করেছেন বলে দাবি তাঁর। যদিও পুলিশের সন্দেহ হয়, মাসে ১৫ হাজার টাকা পেনশন বাবদ আয় হলে ডাক্তার দেখাতে না পারার ব্যাপার আসেকী করে?
বুধবার রাতে ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে পুলিশের সন্দেহ আরও বাড়ে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জেরেই মৃত্যু হয়েছে দেবাশিসের। এর পরে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় শুভাশিসকে। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট শুনে তাঁকে খানিকটা ঘাবড়ে যেতে দেখা যায় বলে পুলিশের দাবি। এর পরে শুভাশিসের দাবি, ‘‘দাদা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। দাদা বলেছিল, আমি না থাকলে তোর চলবে কী করে? আমার মৃত্যুর পরে মুখে একটা বালিশ চাপা দিয়ে রেখে থানায় গিয়ে বলবি যে, তুই-ই খুন করেছিস। তা হলে তোকে নিয়ে আমার আর কোনও চিন্তা থাকবে না।’’
শুভাশিসের এ সব দাবির সত্যতা নিয়ে এখনও সন্দিহান তদন্তকারীরা। ঘটনার তদন্তের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘ঘটনাস্থল থেকে পারিপার্শ্বিক যে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, তার সঙ্গে শুভাশিসের বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রেই মিল নেই। ঘটনাস্থল থেকে মদের বোতল উদ্ধার হয়েছে। তা কেনার টাকা থাকলে চিকিৎসা করানোর টাকা নেই— এটাও মানা কঠিন। জেরায় শুভাশিস জানিয়েছেন, দাদার মৃত্যুর রাতেও তিনি নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু টুল বার বার পড়ে যাওয়ায় তা করতে পারেননি। তাঁর দাদাও নাকি মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খেয়েছিলেন। এই দাবি কতটা সত্যি দেখা হচ্ছে।’’ কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘এক জন ৪৫ বছরের ব্যক্তি কোনও দিনই কেন কোনও পেশার সঙ্গে যুক্ত হননি, সেটা দেখার বিষয়। বরাবর কারও উপরে নির্ভরশীল থেকে যাওয়াই কি এই খুনের গল্প বলার মূলে?’’
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় যদিও বললেন, ‘‘মানসিক সমস্যা যে একটা রয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শুধু অবসাদ বা নির্ভরশীলতা নয়, তার চেয়েও বেশি রয়েছে একটি প্রবণতা। তাঁর নিজের কাজ না করতে চাওয়ার প্রবণতা হতে পারে, পরিবারের লোকজনের তাঁকে কাজ না করতে দেওয়ার প্রবণতাও থাকতে পারে। ওই ব্যক্তির দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়া প্রয়োজন।’’
তবে পুলিশ স্পষ্ট জানিয়েছে, এখনই শুভাশিসকে কোনও হোমে পাঠানোর পরিকল্পনা নেই তাদের। তিনি চাইলেই যে কাজ করে খেতে পারেন, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত বলে দাবি পুলিশকর্তাদের।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।