অপরিসর: বইমেলায় এমন সঙ্কীর্ণ পথ ধরেই যাতায়াত করতে হবে বইপ্রেমীদের। সোমবার, সেন্ট্রাল পার্কে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। নিজস্ব চিত্র
পড়শি রাজ্য অসম বা ত্রিপুরা করে দেখিয়েছে। এমনকী, উত্তরবঙ্গের বইমেলাগুলোও ইতিবাচক উদাহরণ। কিন্তু জনতার আনাগোনার নিরিখে দুনিয়ার সব থেকে বড় বইমেলাই পিছিয়ে থাকল।
প্লাস্টিক মুক্ত বইমেলার স্বপ্ন অন্তত এ বারও অধরা থাকছে। আজ, মঙ্গলবার বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। তার পরে মেলা চলবে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। টানা দিন বারো ধরে লাখ বিশেক লোকের আসা-যাওয়া চলতে পারে। প্রশাসনের আশ্বাস, বইয়ের ক্যারিব্যাগ বা জলের পাউচ দ্রুত সরানো হবে। তবে প্লাস্টিকের রমরমায় শঙ্কিত পরিবেশকর্মীরা। বইমেলা শুরুর আগে এ নিয়ে আয়োজক-শিবির ও বিধাননগরের পুর কর্তৃপক্ষের মধ্যে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে।
পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো বা যত্রতত্র না-ছড়ানোর বিষয়ে আমরা তো পই পই করে মাইকে ঘোষণা করি। কিন্তু একেবারে প্লাস্টিকশূন্য করা প্রশাসনের দায়িত্ব।’’ আর বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তের কথায়, ‘‘বইয়ের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের বিষয়টা প্রকাশকদেরই দেখতে হবে!’’ কিন্তু শুধু তো বইয়ের প্যাকেট নয়, তার বাইরেও প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। তার ব্যবহার বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা কী? এই প্রশ্নের কোনও জবাব সব্যসাচীবাবুর কাছে পাওয়া যায়নি।
প্রশাসন বইমেলা প্লাস্টিকশূন্য করার নির্দেশ চালু না করলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বরাবরের অভ্যাস যে পাল্টানো যাবে না, তা ঠারেঠোরে মানছেন মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ। উদাহরণও রয়েছে আগরতলা, গুয়াহাটির বইমেলায়। স্থানীয় এক ছোট প্রকাশকের কথায়, ‘‘সম্প্রতি ডুয়ার্সের মালবাজারের মেলা ভাল দৃষ্টান্ত রেখেছে।’’
তবে ছোটখাটো বইমেলায় যা করা যায়, কলকাতা বইমেলার মতো বড় পরিসরে তা করা ঢের কঠিন— এটাও বলছেন সকলে। যেমন মেলায় জল সরবরাহের দায়িত্বে থাকা জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের আধিকারিক প্রণয় বিশ্বাস বলছেন, লাখো লোকের মেলায় প্লাস্টিক পাউচের বিকল্প খোঁজা কঠিন। ছোট অনুষ্ঠানে ছোট বোতলের ব্যবস্থা করা যায়। গত বইমেলায় তাঁরা ১০ লক্ষেরও বেশি পাউচের জোগান দিয়েছিলেন। এ বছরও সমান মাপের ব্যবস্থা রাখতেই হবে। বড় প্রকাশকদেরও কারও কারও বক্তব্য, ছোট মেলায় কম বিক্রিতে অল্প সংখ্যক ক্রেতাকে কাপড় বা চটের ব্যাগ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বইমেলায় লাখো লোকের ভিড়ে তা পড়তায় পোষাবে না।
ছোট প্রকাশকদের আবার অন্য সমস্যা। কেউ কেউ জানাচ্ছেন, ছোটদের জন্য পাতলা দু’-একটা বইয়ের জন্য দামি কাগজের ব্যাগ পোষাবে না। ভরসা প্লাস্টিকই। এবং এ বার বৈঠকখানা বাজার থেকে অনেকেই ৪৫ মাইক্রনেরও কম পুরু প্লাস্টিকের ব্যাগ কিনেছেন বলে প্রকাশকেরা কেউ কেউ স্বীকারও করেছেন।
প্লাস্টিক পরিবেশের সঙ্গে মেশে না, কম পুরু প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের যোগ্য নয় এবং তা পোড়ালে বিষাক্ত গ্যাস বেরোয়। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের আশঙ্কা, ‘‘এত প্লাস্টিক জমে সল্টলেকের নিকাশি ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মিলন মেলার তুলনায় সল্টলেকের মতো জনবহুল এলাকায় প্লাস্টিক জমা বেশি বিপজ্জনক।’’ সদিচ্ছা থাকলে কিন্তু প্লাস্টিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব। আনন্দ পাবলিশার্স-এর তরফে সুবীর মিত্র বলছিলেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর হল আমরা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ দিই না। এক ধরনের লাল কাপড়ের ব্যাগ ছাড়া ভারী বইয়ে চটের ব্যাগের ব্যবস্থা থাকে।’’ বড় প্রকাশকদের বাইরেও অভিযান-এর মারুফ হোসেনের দাবি, ‘‘আমরা কিছুতেই প্লাস্টিক দিচ্ছি না। ক্রেতাদের বোঝালে তাঁরা ঠিকই বুঝবেন।’’ আর বড় প্রকাশকদের মধ্যে দে’জ প্রকাশনের শুভঙ্কর দে-র কথায়, ‘‘প্লাস্টিক ব্যবহার এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তবে কমে আসছে। ভবিষ্যতে সকলকেই পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতে হবে।’’
তবে রাজ্য জুড়েই এখনও প্লাস্টিক ব্যবহারে জরিমানার কড়াকড়ি দানা বাঁধেনি। একটি ছোট প্রকাশনার তরফে বুলবুল ইসলাম বলছেন, ‘‘দায়িত্বটা শুধু আমাদেরই বা কেন? প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরি বন্ধ করতেও তো প্রশাসন সক্রিয় হলে পারে!’’