মুখ ঢেকেছে: তারের জালে আটকে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অ্যাসিওরেন্স ভবনের প্রবেশদ্বারের শৈলী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
পুরনো দিনের ঘোরানো সিঁড়ি। উঠতে-উঠতেই দেখা গেল সিঁড়ির দেওয়ালে লেখা, ‘নির্দিষ্ট স্থানে বিজ্ঞাপন মারুন’। বোঝা গেল ওই ভবনও বিজ্ঞাপনত্রস্ত! তাই ভিতরের দেওয়ালেই সেই নিষেধাজ্ঞা লিখে রাখতে হয়েছে।
ভবনের একতলা ও দোতলায় রাজ্য সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের অফিস রয়েছে। দফতরের এক কর্তা জানালেন, বছর চারেক আগে ভবন সংস্কারের কাজ করা হয়েছিল। তখন নতুন করে রং করা হয়। না হলে তো অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। ‘পরি’কে আলাদা ভাবে চেনার উপায় ছিল না!
অর্ধচন্দ্রের মতো প্রবেশদ্বার। তার উপরে গোটা গোটা হরফে লেখা ‘স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অ্যাসিওরেন্স কোম্পানি’। সেই বড় হরফের নীচে দরজার এক পাশে দেখা গেল উড়ন্ত এক পরি! স্থাপত্যশৈলীর বিচারে যার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। যদিও সে সব এখন অতীতগামী। যুবকল্যাণ দফতরের এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘পূর্ত দফতর আমাদের দফতরের তলাগুলো শুধু রক্ষণাবেক্ষণ করে। কিন্তু যখন মেরামতি করা হয়েছিল, তখন রাজ্য সরকারের তরফেই অন্য অংশেও সারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাকি অংশে কে কী করছে, তা বলতে পারব না।’’
অবশ্য যুবকল্যাণ দফতর এখানে শুধুমাত্র ভাড়াটে হিসেবে রয়েছে। ভবনের অপর অংশে সরকারের অন্য অফিসও রয়েছে। কিন্তু তারাও মালিক নয়। বেসরকারি মালিকানা। তাদের সঙ্গে আইনি জটিলতাও চলছে সরকারের। সূত্রের খবর, তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ওই ভবনের প্রথম দুই তলা কেনার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। সরকারের তরফে প্রায় এক কোটি টাকা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালিকপক্ষের তরফে দাম বলা হয়েছিল প্রায় তিন কোটি। স্বাভাবিক ভাবেই আর কথা এগোয়নি।
ব্রিটিশ ভারতে বি বা দী বাগ অঞ্চলেই একের পর এক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান শাখা বিস্তার করেছিল, যার মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অ্যাসিওরেন্সের ভবন ছিল অন্যতম। ইতিহাস বলছে, ঔপনিবেশিক ভারতে অন্য বিমা সংস্থা সহজে আসতে চাইত না। কারণ, এখানকার ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যুহার! কিন্তু সে সময়ে এই সংস্থা ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের কথা ভেবে নিজেদের বাণিজ্য শুরু করেছিল। সে সময়ের অন্যতম সেরা বিমা সংস্থা ছিল তারাই।
তবে ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের যোগ ওইটুকুই। ভবনটির বাইরে অগুনতি তার ঝুলছে। নোংরা ছড়িয়ে রয়েছে দরজার মুখেই। ভিতরে লম্বা প্যাসেজ আপাতত গাড়ি রাখার জায়গা। মালিকপক্ষ বিদেশে থাকেন। এখানে ভাড়া নেওয়ার জন্য শুধু একজন ‘রিসিভার’ রয়েছেন। ওই ভবনের নীচে একটি রেস্তরাঁ-পানশালাও রয়েছে। তবে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য পার্থরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘হেরিটেজ আইনে এই জায়গায় ধোঁয়াশা রয়েছে। হেরিটেজ ভবনে পানশালা বা রেস্তরাঁ থাকতে পারে কি না, তা স্পষ্ট করে বলা নেই।’’
যিনি এই ভবনের নকশা তৈরি করেছিলেন সেই স্থপতি ফ্রেডরিক ডব্লু স্টিভেনসের উপরে রাইটার্স বিল্ডিংসের উপস্থিতির ‘চাপ’ ছিল। কারণ, স্থাপত্যশৈলীর বিচারে রাইটার্স বিল্ডিংস ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী! রাইটার্সের সেই নান্দনিক আগ্রাসনের মধ্যেই চলেছিল সম্মানজনক উপস্থিতির খোঁজ। স্টিভেনস তখন রীতিমতো বিখ্যাত। কারণ, উপমহাদেশের স্থাপত্যশৈলীর তিনটি পালক তাঁর মুকুটে। মুম্বইয়ের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস, মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ও চার্চগেটের ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে হেড কোয়ার্টার— তিনটি ভবনেই তাঁর ছোঁয়া। ১৮৯৫ সালে তৈরি হওয়া কলকাতায় এটিই তাঁর একমাত্র ভবন। স্টিভেনসের হাত ধরেই দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র মুম্বই ও তৎকালীন ভরকেন্দ্র কলকাতা মিলে গিয়েছিল।
সেই মুম্বই থেকেই সম্প্রতি এক বিশেষজ্ঞ দল এসেছে। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অ্যাসিওরেন্স ভবনের পাশেই হংকং হাউস, যা বেসরকারি এক ব্যাঙ্কের কলকাতায় সদর দফতর, তার সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। এই ভবনও ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতির এক প্রতীক। ভবনের সংস্কারের কারণ, গাড়ির ধোঁয়াধুলোয় হংকং হাউসের পাথরের গায়ে কালো কালো ছোপ পড়ে গিয়েছে। তাই তড়িঘড়ি করে বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ওই বেসরকারি সংস্থার এক কর্তার কথায়, ‘‘হাই ট্র্যাফিক জোন হওয়ায় ধোঁয়াধুলো হয়। তাতেই ভবনের স্যান্ডস্টোনে ময়লার আস্তরণ পড়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর তা পরিষ্কার করা হয়। এ বারও সংস্কারের কাজের জন্য মুম্বইয়ের সদর দফতর থেকে বিশেষজ্ঞ দল এসেছে।’’ তথ্য বলছে, ১৯১০ সালে এই ভবনের নির্মাণ শেষ হয়েছিল। ১২ লক্ষ টাকায় তৈরি হয়েছিল এই ভবন। পাথরের শৈলীর মধ্যেই একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। বেসরকারি ব্যাঙ্কের এক কর্তার কথায়, ‘‘পাথরের ক্ষতি যাতে না হয়, সে দিকে নজর রাখা হয় সব সময়ই।’’
কিন্তু নজর রাখলে কী হবে! রাজ্য পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে খবর, শহরে ধূলিকণার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। যা ক্ষতিগ্রস্ত করছে হেরিটেজ ভবনকেও। যেমন ধূলিকণা জমতে-জমতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সাদা মার্বেলেও কালচে ছোপ পড়ে গিয়েছিল। মেমোরিয়ালের সংস্কারের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা এনবিসিসি (ইন্ডিয়া) লিমিটেড (ন্যাশনাল বিল্ডিংস কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন লিমিটেড) সূত্রে জানা গিয়েছিল, সংস্কারের সময় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কেজির ধুলো বেরিয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মার্বেলের গা থেকে!
হংকং হাউসের ক্ষেত্রে সেই ধুলোর পরিমাণ কত, তা অবশ্য জানা যায়নি!
(চলবে)