গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-কাণ্ডের আবহে ডুরান্ড কাপের গ্রুপ পর্বে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভের স্বর শাসকদল তৃণমূলের অন্দরেও। কেউ কেউ মনে করছেন, এতে ‘ভুল বার্তা’ যাবে জনমানসে। অন্য একটি অংশ অবশ্য ম্যাচ বাতিলের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছেন। তাঁদের মতে, নানা দিকে মিছিল-মিটিং-জমায়েত সামলাতে প্রতি দিন যে সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন করতে হচ্ছে, তাতে ডার্বির মতো ম্যাচ করানো এই মুহূর্তে মুশকিল।
বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভের কথা ঘরোয়া আলোচনায় অনেকেই গোপন করছেন না। কুণাল ঘোষের মতো প্রকাশ্যে মন্তব্য না-করলেও, শাসকদলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘শুক্রবার রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সারা বাংলায় ‘খেলা হবে’ দিবস পালিত হয়েছিল। কিন্তু রবিবার সেই রাজ্য সরকারের বদান্যতাতেই ‘খেলা হবে না’ দিবস পালিত হবে। এর থেকে লজ্জাজনক আর কিছু নেই।’’ একই ভাবে বিরোধীরাও ডার্বি বাতিলকে ‘শাসকদের ভয়’ হিসাবে দেখাতে চাইছেন। তেতে উঠেছে ময়দান-রাজনীতিও। দুই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকা বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা পারস্পরিক আলোচনাও শুরু করেছেন, রবিবারে পৃথক ভাবে কোনও প্রতিবাদের কর্মসূচি নেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে।
মোহনবাগান ক্লাবের অন্যতম কর্তা তথা তৃণমূল নেতা কুণাল তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘আমি এক জন মোহনবাগান এবং তৃণমূল সমর্থক হিসেবে কাল রবিবার ডুরান্ড ডার্বির পক্ষে। প্রশাসন বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুক। যদি কেউ ‘বিচার চাই’ ব্যানার দেখায়, দেখাক। উস্কানির অন্য ব্যানার উপেক্ষা করুন। কিন্তু ডার্বি স্থগিতে ভুল বার্তা যাবে। বামরাম কুৎসা বাড়বে। খেলা হোক।’’ দক্ষিণ কলকাতার এক তৃণমূল নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, ‘‘রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসেরই উচিত ছিল এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে ম্যাচ করানোর। তাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হত। যত বাধা দেওয়া হবে, তত পরিস্থিতি জটিল হবে। মানুষের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ জমবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘যাঁরা প্রশাসনকে বুদ্ধি দেন, তাঁদের যে বাস্তবের মাটিতে পা নেই তা সর্বোচ্চ স্তরের বোঝা উচিত।’’ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে যুক্ত উত্তরবঙ্গের এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘প্রশাসনে যাঁরা বিধাতা হয়ে রয়েছেন, তাঁরা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সমর্থকদের নাড়িই বোঝেন না। এটা করে প্রতিবাদের আগুনে আরও ঘি ঢেলে দেওয়া হল।’’ যদিও তৃণমূলের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, প্রশাসন সঠিক ভাবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজের এলাকায় ক্রীড়া সংগঠক হিসাবে পরিচিত হুগলির এক বিধায়ক বলেন, ‘‘মাঠের প্রতিবাদ শুধুমাত্র ব্যানার-টিফোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না-ও থাকতে পারে। তা হিংসাত্মক আকার নেবে না তার কী মানে আছে? স্টেডিয়ামে ভাঙচুর হবে না, সেই গ্যারান্টিই বা কী? তাই তপ্ত পরিস্থিতে সাবধানতা অবলম্বন করাই সঠিক সিদ্ধান্ত।’’
সূত্রের খবর, শহরের উত্তপ্ত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে পুলিশের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়, শহরে বিভিন্ন জায়গায় এত পরিমাণে পুলিশকর্মী দেওয়া হয়েছে যে, ডার্বির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন সম্ভব নয়। এ ছাড়া গত কয়েক দিন ধরে সমাজমাধ্যমে দু’দলের সমর্থকেরাই আরজি কর-কাণ্ডে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। ফুটবল সমর্থকদের একাংশ আরজি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ টিফোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কয়েকটি সমর্থক-দলের তরফে ঘোষণাও করা হয়, ম্যাচের দিন ব্যানার, টিফোর মাধ্যমে ঘটনার প্রতিবাদ করা হবে।এই ধরনের টিফো পরিস্থিতি জটিল করতে পারে বলেও আশঙ্কা পুলিশ-প্রশাসনের। সব মিলিয়েই রবিবার ডুরান্ডের ডার্বি নিয়ে আপত্তি জানানো হয় পুলিশ-প্রশাসনের তরফে। তাতেই সিলমোহর পড়ে।
প্রত্যাশিত ভাবেই ডার্বি বাতিল নিয়ে সরকার তথা শাসকদলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধীরা। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘আমি এক জন ফুটবলপ্রেমী হিসাবে বলছি, সরকার ভয় পেয়ে গিয়েছে। না হলে এই সিদ্ধান্ত কেউ নেয়? সারা দুনিয়ায় ফুটবল মাঠের গ্যালারি নানা সময়ে প্রতিবাদের জায়গা হয়ে উঠেছে। রবিবারের ডার্বিতেও দু’দলের সমর্থকেরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্লোগান দেওয়ার— ‘দুই গ্যালারির এক স্বর, আরজি কর আরজি কর’। তাতেই প্রশাসন ভয় পেয়ে গিয়েছে।’’ সেলিম আরও বলেন, ‘‘আমি দুই প্রধানের সমর্থকদের কাছে আশা করব, তাঁরা রবিবার নিজেদের দলের পতাকা, জার্সি নিয়ে আরজি করের জন্য সরব হবেন এবং ডার্বি বাতিলেরও প্রতিবাদ করবেন।’’ রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ী বলেন, ‘‘কতখানি ভয় পেলে একটা সরকার বাঙালির আবেগকে বাতিল করে দিতে পারে। এরা আবার নাকি বাংলা এবং বাঙালিয়ানার কথা বলে।’’
অতীতে এনআরসির সময়ে দুই প্রধানের গ্যালারিতে প্রতিবাদ জানিয়ে টিফো ঝুলেছিল। উত্তর-পূর্বের একটি রাজ্যের স্থানীয় লিগে মণিপুরের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সমর্থকেরা। ফলে ভারতে ফুটবল মাঠের গ্যালারিতে সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও ঘটনার প্রতিবাদ হওয়া নতুন নয়। শাসকদলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, ম্যাচ না করার সিদ্ধান্তে আসলে সরকার এবং প্রশাসনেরই ব্যর্থতা প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। যা দলের জন্য অস্বস্তির।