সত্যব্রত বাবুর ব্যবসায়িক জীবনের প্রথমটা শুরু লিন্ডসে স্ট্রিটের ছোট্ট একটা দোকান থেকেই।
Shoe

জুতো হাতে এক বাঙালির অজানা লড়াইয়ের আখ্যান, শ্রীলেদার্সের নেপথ্যে থাকা এক সাম্রাজ্য তৈরির গল্প

আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সত্যব্রতবাবুর নেতৃত্বেই এগিয়ে চলেছে শ্রীলেদার্স। লিন্ডসে স্ট্রিটের ছোট্ট সেই দোকান থেকে এক এক করে অনেকগুলি স্টোর তৈরি করে ফেলেছে তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩৫
Share:

জুতো হাতে সত্যব্রত দে

শহর কলকাতার রাস্তা-ঘাটে, মেট্রো-বাসে, যতগুলো লোক দেখতে পাই, তাদের অন্তত বেশিরভাগ মানুষের পায়ের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে পরিচিত একটি লোগো। খুব প্রাচীন, আবার খুব নতুনও। চোখ বন্ধ করে আপনি বলে দিতে পারবেন, বেশিরভাগ বাঙালি আজও জুতো কেনার সময়ে শ্রীলেদার্সকে সাদরে গ্রহণ করেছে। এ তো গেল রোজের গল্প। কিন্তু এই শ্রীলেদার্সের ইতিহাস কত জনই বা জানেন?

ঠিক একটি ছোট্ট বীজ বপন করলে যেমন ভাবে পরবর্তী সময়ে তা মহিরুহের আকার নেয়, শ্রীলেদার্সের গল্পটাও ঠিক তেমন। ছোট্টা একটা দোকান থেকে সুবিশাল এক সাম্রাজ্য। বেলা অবেলায় বাঙালির পায়ে পায়ে পথ চলার সঙ্গীর শুরুটা যাঁর হাত ধরে তিনি হলেন সত্যব্রত দে। নিপাট একজন বাঙালি ভদ্রলোক, যাঁর চোখে ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বাঙালি যে ব্যবসাতেও মহাকাশ ছুঁয়ে মেঘকে আলিঙ্গন করতে পারে, সত্যব্রত দে যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

যে ব্যবসা আজ পর্বতের শিখরকে চুম্বন করেছে, পায়ে পায়ে যে ব্র্যান্ডকে সাদরে গ্রহণ করেছে বাংলা ও বাঙালি, সেই সাম্রাজ্য তৈরির প্রথমটা শুরু কিন্তু ততটাও সহজ ছিল না। এক প্রকার আকাশ কুসুম পরিকল্পনা নিয়ে কলকাতায় পা রেখেছিলেন সত্যব্রত দে। চোখে ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন এক সাম্রাজ্য বিস্তারের। খানিক মজা করে বললে, বাংলা ও বাঙালির পথচলার দায়িত্বের গুরুভার নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন সত্যব্রত দে।

সত্যব্রত দে ও শিপ্রা দে

সত্যব্রত বাবুর ব্যবসায়িক জীবনের প্রথমটা শুরু লিন্ডসে স্ট্রিটের ছোট্ট একটা দোকান থেকেই। যেটি মাইকেল নামে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন সত্যব্রত বাবু। ছোট্ট সেই দোকানই আজ সত্যব্রত বাবুর স্বপ্নপুরী— শ্রীলেদার্স। হাতে গোনা ছোট্ট, কয়েকশ স্কোয়ার ফুট জায়গায় হাতে খড়ি হয়েছিল সেই জুতোর দোকানের। সালটা ১৯৮৬। সযত্নে লালন করে সেই এক ফালি দোকান থেকেই তিল তিল করে সত্যবাবু গড়ে তুলেছেন এক অবিনশ্বর জগত। তাঁর কথায়, এই জগতের পরিধি আসলে অনেকটা বড়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে খুব ভালবেসে এই পৃথিবীকে তৈরি করেছে।

ছোটবেলায় প্রত্যেকেই আমরা শুনেছি পরিশ্রমই সাফল্যের পথ দেখায়। সাফল্যের এই রূপকথায় পরিশ্রমের দিক থেকে কোনও কার্পণ্য করেননি সত্যব্রত বাবু। সারাদিনে রাতে এক বার খেয়েই কেটে যেত দিন। প্রায় ৩ কিলোমিটার হেঁটে যেতেন বাবুঘাটের কুস্তি আখরায়। কারণটা ছিল ১ টাকায় খাবার। ১৯৮৯ সাল বিয়ে করেন স্ত্রী শিপ্রা দে-কে। বিয়ের পরে থাকার ঠিকানা ছিলনা, তখন প্রিয় বন্ধু গোপাল ফৌজদার নিজেই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। বিয়ের পরের দিনেই বন্ধু গোপাল ফৌজদারের বাড়িতে স্ত্রীকে রেখে সটান চলে আসেন লিন্ডসে স্ট্রিটের দোকানে। দু'চোখ জুড়ে তখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়ার অদম্য লড়াই।

বিয়ের মণ্ডপে

কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও কোথায় শ্রীলেদার্স আলাদা জানেন? তাদের বিজনেস মডেল। যে কথা নিজেও স্বীকার করে নিলেন খোদ সত্যব্রত বাবু। সেই প্রথম দিন থেকেই শ্রীলেদার্স তাদের প্রোডাক্টের গুণমান, কাস্টমার এবং ভেন্ডরদের উপরেই জোর দিয়েছে। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে প্রোডাক্ট অর্ডার দেওয়া এবং তার পেমেন্ট করা ছিল বাধ্যতামূলক। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সেই প্রথাই অনুসরণ করছে তারা। যার ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যবসা। সেই সঙ্গে কর্মচারীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাতেও সর্বদায় নজরে রাখেন তিনি। এক সঙ্গে কোমর বেঁধে ওই লিন্ডসে স্ট্রিটের দোকানে দাঁড়িয়ে থেকে জুতো বিক্রি করেছেন, ক্যাশ সামলেছেন। পুজোর চাপের মধ্যে কোনও এক ফাঁকে কর্মচারীদের সঙ্গে বসে দুপুরের খাবার সেরে নিতেন। পুরনো দিনের তেমনই এক গল্প বলতে গিয়ে নিজেই হেসে উঠলেন সংস্থার মালকিন শিপ্রা দে। বহু পুরনো কথা। ছোট্ট দোকান, এসি নেই। একবার এক কাস্টমার এগিয়ে এসে শিপ্রা দের সামনেই এক কর্মচারীকেই বলে ফেললেন, ‘দেখুন, আপনাদের এই গরমে কাজ করতে বসিয়ে, মালিক ঠাণ্ডা ঘরে আরামে বসে রয়েছে।’ কথা শুনে মনে মনে বেশ হেসেছিলেন শিপ্রা দে। সত্যব্রতবাবু নিজেও মনে করেন যে এই জায়গাতেই বাকিদেরকে পিছনে ফেলে সমান তালে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে শ্রীলেদার্স।

সত্যব্রত দে এবং শিপ্রা দে

আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সত্যব্রতবাবুর নেতৃত্বেই এগিয়ে চলেছে শ্রীলেদার্স। লিন্ডসে স্ট্রিটের ছোট্ট সেই দোকান থেকে এক এক করে অনেকগুলি স্টোর তৈরি করে ফেলেছে তারা। কিন্তু সময় বদলেছে। সাফল্যের সেই শিখর ধরে রাখতে তৈরি হয়ে গিয়েছে পরবর্তী প্রজন্ম। ব্যবসা যে পরিবারের রক্তে রয়েছে, সেই পরিবারের আর কিছু নতুন করে শেখার প্রয়োজন রয়েছে কি! শিপ্রা দেবীর কথায়, হ্যাঁ রয়েছে। বিদেশে পড়াশুনা করে তাঁদের মেয়ে — রচিতা দে, যিনি সংস্থার উত্তরসূরিও, ইতিমধ্যেই হাল ধরে নিয়েছেন ব্যবসার। সান ফ্রান্সিসকো থেকে স্নাতক হওয়ার পরে রচিতা দে, একটি ই-কমার্স স্টার্ট আপে অ্যানালিস্ট হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। এর পরে সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে যোগ দেন নিজেদের ব্যবসায়। লক্ষ্য সংস্থাকে আরও উপরের দিকে এগেয়ে নিয়ে যাওয়ার। বাবার নিজের হাতে তৈরি করা স্বপ্নকে সেই জায়গায় ঠাঁই দেওয়ার, যে জায়গার কথা হয়তো নিজেও ভাবতে পারেননি সত্যব্রত বাবু এবং শিপ্রা দে। একই সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাত শক্ত করছেন সংস্থার আরও এক উত্তর প্রজন্ম - 'দে' বাড়ির ছেলে— সোহম দে। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বর্তমানে পড়াশুনা করছেন তিনি। সময় পেলেই হাত লাগান নতুন নতুন প্ল্যানিংয়ে।

পুরনো সেই দিনগুলো

সময়ের সঙ্গে তাল রেখেই নিজের ছন্দে এগিয়ে চলেছে শ্রীলেদার্স। এসপ্ল্যানেড চত্বরে দুর্গাপুজোর লম্বা লাইন আজও মনে করিয়ে দেয় শ্রীলেদার্সের সুখপাঠ্যের গল্প। কে বলেছে বাঙালিরা ব্যবসা করতে পারে না? সত্যব্রত বাবু সেই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীলেদার্সের ইতিহাস তুলে ধরেন। যত বার কলকাতায় জুতোর ছন্দে ধুলো উড়বে, ততবার মনে পড়বে লিন্ডসে স্ট্রিটের শ্রীলেদার্সের আখ্যানের কথা। সত্যব্রত বাবুর এক অজানা লড়াইয়ের কথা। যে লড়াই অক্ষরে অক্ষরে লিখলে মহাকাব্যের আকার নেবে। বাঙালির পায়ের সঙ্গী হয়ে চিরকাল অক্ষয় থেকে যাবে শ্রীলেদার্স।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন