অরক্ষিত: দরজায় নেই রক্ষী। হাওড়া স্টেশনে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
শতাব্দীপ্রাচীন ভবনের একটি ঘরের সামনে কাঠের পেল্লায় দরজা ঘুণ ধরে নড়বড়ে। জোরে ধাক্কা দিলেই ভেঙে পড়তে পারে। অরক্ষিত সেই দরজা পেরোলেই বড়সড় একটি ঘর। কালো ছোপ ধরা দেওয়াল আর ঝুল দেখলেই বোঝা যায়, দীর্ঘদিন ওই ঘরের কোনও সংস্কার হয়নি। হাওড়া স্টেশনের ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে এক পুরনো দোতলা বাড়ির নীচের তলার এই ঘরই ওই স্টেশনের অর্থভাণ্ডার বা স্ট্রং রুম।
প্রায়ান্ধকার সেই ঘরে ঢুকে দেখা গেল, এক দিকে ভাঙাচোরা কাঠের ট্রলি, স্তূপীকৃত মালবোঝাই বস্তা, ওজন করার যন্ত্র, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা একাধিক টিনের বাক্স। অন্য দিকে তারের জাল দেওয়া তিনখানা খোপ। প্রতিটিরই দরজা পুরো খোলা। এমনই একটি খোপে মরচে ধরা একটি সিন্দুকের সামনে চেয়ারে বসে তাড়া তাড়া নোট গুনে চলেছেন এক কর্মী।
নামেই স্ট্রং রুম। আসলে যে কেউ ওই ঘরে বিনা বাধায় ঢুকে পড়তে পারে। অবাধে পৌঁছে যেতে পারে তারের জালে ঘেরা ক্যাশঘরেও। স্টেশন সূত্রের খবর, সম্পূর্ণ অরক্ষিত ওই ঘরেই থাকে স্টেশনের পার্সেল থেকে আয় হওয়া লক্ষ লক্ষ টাকা। সেই সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক-সহ বিভিন্ন পরীক্ষার উত্তরপত্র ও দামি সামগ্রীও।
স্ট্রং রুমে কর্মরত এক পদস্থ রেলকর্মী জানান, পার্সেল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪০-৪৫ লক্ষ টাকা ক্যাশ বাক্সে জমা পড়ে। কোনও ভাবে পরপর ছুটি বা ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকলে জমা টাকার অঙ্ক অনেক সময়ে কোটি ছাড়িয়ে যায়। টাকার পরিমাণ যত বাড়ে, ততই রক্তচাপ বাড়তে থাকে কর্মীদের। তখন দিনরাত পাহারা দিয়ে টাকা আগলাতে হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের। কারণ, কোনও অঘটন ঘটলে দায় তাঁদেরই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেলকর্মী বলেন, ‘‘দরজায় কোনও পাহারা না থাকায় সশস্ত্র কেউ ঢুকে পড়ে লুঠপাট চালালে আমাদের কিছু করার থাকবে না। তাই সর্বক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেই কাজ করতে হয়।’’
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে স্ট্রং রুমটি ছিল অনেকটা বড়। কিন্তু ডিআরএম–এর হেল্থ ইউনিট-কে ঘরের অর্ধেকটা দিয়ে দেওয়ায় স্ট্রং রুম ছোট হয়ে য়ায়।
শুধু তা-ই নয়, সেই অর্ধেক স্ট্রং রুমের একাংশ আবার ব্যবহৃত হয় আরপিএফ-এর বিশ্রামকক্ষ হিসেবে। সেখানে পাতা থাকে তাদের বিছানা। ক্যাশঘরের তারের জালের দেওয়াল আবার ব্যবহৃত হয় আরপিএফ জওয়ানদের ‘আলনা’ হিসেবে। সেখানে ঝোলে তাঁদের গেঞ্জি, গামছা।
স্ট্রং রুমে বিশ্রাম নিতে গেলেও আরপিএফ জওয়ানরা কিন্তু ওই ঘরের নিরাপত্তা নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। সেটা শুধুই তাঁদের বিশ্রামাগার। ওই ঘরের সুরক্ষার বিষয়টি দেখার কোনও দায় তাঁদের নেই। তাই আরপিএফ জওয়ানদের অনবরত আসা-যাওয়া থাকলেও স্ট্রং রুম থেকে
যায় অরক্ষিতই।
স্ট্রং রুমের দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার অনিল শ্রীবাস্তবের অভিযোগ, ‘‘এ ঘরের নিরাপত্তা তো নেই-ই, বিপদ হলে খবর দেওয়ার জন্য একটা টেলিফোনও দেওয়া হয়নি আমাদের।’’ তিনি জানান, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা ক্যাশ কাউন্টারে জমা পড়লেও তা গোনার জন্য কোনও যন্ত্র দেয়নি রেল। এমনকী, জাল নোট ধরার কোনও ব্যবস্থাও নেই। তাই হিসেবে কোনও ভুলচুক হলে দায়িত্বে থাকা কর্মীদেরই পকেট থেকে সেই টাকা দিতে হয়।
হাওড়া স্টেশনের নিরাপত্তা বাড়াতে যখন কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, তখন স্টেশনের স্ট্রং রুমের এই হাল কেন?
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ অফিসার রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘স্ট্রং রুমের অবস্থা এ রকম হওয়ার তো কথা নয়। কেন এমন হাল, তা আমরা খোঁজ নিয়ে দেখে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেব।’’