চিকিৎসা বিভ্রাটের শিকার বালককে ‘ব্রাত্য’ করছেন শিক্ষক

অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ ছুটির পরে যখন দরখাস্ত নিয়ে ক্লাসে ঢুকল ছেলেটি, শিক্ষক সকলের সামনেই বললেন, ‘‘তোর বাজে রোগ হয়েছে। আর স্কুলে আসবি না।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৬ ০১:২১
Share:

অভিজ্ঞানকিশোর দাস

অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ ছুটির পরে যখন দরখাস্ত নিয়ে ক্লাসে ঢুকল ছেলেটি, শিক্ষক সকলের সামনেই বললেন, ‘‘তোর বাজে রোগ হয়েছে। আর স্কুলে আসবি না।’’ হুগলির একটি সরকারি স্কুলের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর, শিক্ষা দফতর থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকী প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি লিখেছেন ওই পড়ুয়ার বাবা। তাঁর অভিযোগ, স্কুলে যা হয়েছে তা মানসিক নির্যাতনের সামিল। সহপাঠীদের সামনে শিক্ষকের ওই আচরণে আতঙ্কিত, অপমানিত হয়ে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে তাঁর ন’বছরের সন্তান।

Advertisement

ওই পড়ুয়ার বাবা জানান, তাঁর ছেলের যক্ষ্মা হয়েছে কি না, তা নিয়ে টালবাহানা চলেছে সেপ্টেম্বর থেকে। যক্ষ্মা হয়েছে ধরে ওষুধ চালু করে দিয়েছিলেন কলকাতার চিকিৎসকেরা। যদিও দক্ষিণ ভারতে গিয়ে সেই বিভ্রান্তির অবসান হয়েছে, দুর্ভোগ মিটছে না। এখনও ‘টিবি রোগী’র তকমা লেগে তার গায়ে। তাঁর প্রশ্ন, যদি সত্যিই যক্ষ্মা হয়ে থাকত, তা হলে তো এ ভাবেই একঘরে করে রাখার চেষ্টা হত তাঁর সন্তানকে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যদি এমন সংস্কার থাকে, বাকিরা কী শিখবেন?

চুঁচুড়ার বাসিন্দা অভিজ্ঞানকিশোর দাস হুগলি কলেজিয়েট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে তার কাশি, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। একবালপুরের এক হাসপাতালে চিকিৎসকেরা জানান, অভিজ্ঞানের যক্ষ্মা হয়েছে। সেই অনুযায়ী অভিজ্ঞানকে হাওড়া জেলা যক্ষ্মা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও যক্ষ্মা হয়েছে জানিয়ে ডটস-এর আওতায় চিকিৎসা চালু করতে বলা হয়। কিন্তু সেই ওষুধ খেয়ে তার অবস্থার অবনতি শুরু হলে এনআরএসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, যক্ষ্মার সঙ্গে মেনিনজাইটিসও হয়েছে তার। শুরু হয় আর এক প্রস্ত চিকিৎসা। তাতেও অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এর পরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে গেলে যক্ষ্মার ওষুধ বন্ধ করতে বলা হয়। বিভ্রান্ত পরিজনেরা শেষে তাকে ভেলোরে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা লিখিত ভাবে জানান, তেমন কোনও অসুখই হয়নি অভিজ্ঞানের। যা হয়েছে তা উপসর্গভিত্তিক সমস্যা। সঙ্গে এক-এক ডাক্তার এক-এক রকম কথা বলায় আতঙ্কিত হয়ে তার শারীরিক-মানসিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। অভিজ্ঞানকে শান্ত রাখার পরামর্শ দেন তাঁরা।

Advertisement

অভিজ্ঞানের বাবা অনিন্দ্যকিশোর দাস বলেন, ‘‘৩০ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর ভেলোরে হাসপাতালে ভর্তি ছিল আমার ছেলে। সেখানকার চিকিৎসকদের কথা আমাদের খুব শান্তি দিয়েছিল। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে ছেলে স্কুলে গেলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হবে। ভেলোরে যাওয়ার আগে আমি স্কুলের টিচার ইন চার্জকে সব জানাই। এমনকী, ২১ নভেম্বর ছেলে যখন ফের স্কুলে যায়, তখন ছুটির দরখাস্তের সঙ্গে ভেলোরের ডাক্তারদের বক্তব্যও বিস্তারিত জানাই। ক্লাস টিচার সেটি নিতেই অস্বীকার করেন এবং বাজে রোগ হয়েছে বলে ছেলেকে স্কুলে আসতে বারণ করেন। এর মধ্যে আমার ছেলে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছে বলেও দোষারোপ করেন। এমনটা হবে, কল্পনাও করতে পারিনি।’’

অনিন্দ্যবাবু বলেন, ‘‘ছেলে ক্লাসে ঢুকতেই টিচার অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেন। ছেলে ভয়ে-লজ্জায় কেঁদে ফেলে। বাড়ি ফিরে সব জানালে আমি স্কুলে যোগাযোগ করি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্কুল থেকে যোগাযোগ করা হয়নি।’’ তিনি জানান, সেই থেকে বাইরে যেতে চাইছে না তাঁর ছেলে। ‘‘টানা মাস দেড়েক আমাদের কেটেছে রোগ নির্ণয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে। এর পরেও যদি
এমন অবস্থা হয়, তার দায় কে নেবে,’’ প্রশ্ন অনিন্দ্যবাবুর।

স্কুলের টিচার ইন-চার্জ মধুসূদন আচার্য বলেন, ‘‘যা ঘটেছে তা কখনওই কাম্য নয়। ছেলেটির অভিভাবকদের বলেছি, ওকে স্কুলে পাঠান, আমি নিজে সব দেখব।’’ অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কি তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন? তিনি বলেন, ‘‘ওই শিক্ষক এই ঘটনার পরে স্কুলে আসেননি। আমি ফোনে ওঁকে সব জানিয়েছি। কাজটা যে অত্যন্ত গর্হিত, বলেছি। তিনি স্কুলে এলে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করব।’’ অভিযুক্ত শিক্ষক কিংশুক পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

তবে বিষয়টি যে শিক্ষা দফতরকে ঘোর অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা বোঝা গিয়েছে দফতরের কর্তাদের প্রতিক্রিয়ায়। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কোনও পড়ুয়াকে, সে অসুস্থ হোক বা না হোক, এমন মানসিক ভাবে আঘাত করতে পারেন না শিক্ষক। আমরা অভিযোগটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এমন হয়ে থাকলে আমরা ওই শিক্ষককে অবশ্যই সতর্ক করব। প্রয়োজনে কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’’

স্বাস্থ্য ভবনে যক্ষ্মা বিভাগের কর্তারাও জানান, এই ঘটনা জেনে তাঁদের মনে হচ্ছে, তাঁরা কয়েক দশক পিছিয়ে গিয়েছেন। এক কর্তার কথায়, ‘‘বহু বছর আগে যক্ষ্মা রোগীদের নিয়ে এমন ছুৎমার্গ ছিল। লাগাতার প্রচারে তা কেটেছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আমরা যে এখনও অনেক পিছিয়ে, তা আবার প্রমাণ হল।’’

চলতি মাসের শেষেই অভিজ্ঞানের পরীক্ষা শুরু। আদৌ কি সে পরীক্ষা দিতে পারবে? চুঁচুড়ার বাড়িতে বসে বুধবার সে বলল, ‘‘হাসপাতালে ছিলাম বলে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারিনি। এ বার কি তা হলে নতুন ক্লাসে ওঠার পরীক্ষাটাও দিতে পারব না? ভেলোরের ডাক্তারবাবুরা তো বলেছেন, আমি সুস্থ। তা হলে স্যার এ রকম বললেন কেন?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement