মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার সন্ধ্যায় সল্টলেকের ডিডি ব্লকে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে সবেমাত্র বেরিয়ে গিয়েছেন। অনুষ্ঠানে তখনও রাজ্যের বিভিন্ন নেতা, মন্ত্রী-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত। নিরাপত্তা ও নজরদারি তখন জোরকদমে। সেই কড়া নিরাপত্তার মাঝে ওই অনুষ্ঠানস্থল থেকে কিছু দূরে সি ই ব্লকের একটি বাড়িতে ৭-৮ জন সশস্ত্র দুষ্কৃতী ঘরে থাকা মহিলাদের বেঁধে রেখে গয়না, নগদ টাকা, মূল্যবান একাধিক ঘড়ি, মোবাইল ফোন অবাধে লুঠ করে পালিয়ে গেল। ঘটনার গুরুত্ব এতটাই যে খোদ পুলিশ কমিশনার জ্ঞানবন্ত সিংহ-সহ শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের ছুটতে হয়েছে ঘটনাস্থলে।
কিছু দিন আগেই সল্টলেক উত্তর থানা এলাকাতেই একটি উবেরে এক তরুণীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছিল। তার কয়েক দিনের মধ্যে এমন ডাকাতির ঘটনায় বাসিন্দারা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতির কারণে ডিডি ব্লক সংলগ্ন এলাকা এবং ১ ও ৩ নম্বর সেক্টর জুড়ে পুলিশের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তা সত্ত্বেও কিছু দূরের একটি ব্লকে ডাকাতি হল। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ব্লকের ভিতরে পুলিশের নজরদারি প্রায় উঠে গিয়েছে বললেই চলে। বড় রাস্তাতেই পুলিশ অপরাধ ঠেকাতে পারছে না, তাঁরা কী ভাবে ব্লকের ভিতরে নজরদারি চালাবে? সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী সাড়ে সাতটা নাগাদ ডিডি ব্লক থেকে রওনা হয়ে সল্টলেক থেকে বেরিয়ে যান। ডাকাতির ঘটনা ঘটে পৌনে আটটা থেকে সওয়া আটটার মধ্যে।
ঘটনার পরে রাতভর সল্টলেকে নাকা করে বিভিন্ন মোড়ে তল্লাশি চালায় পুলিশ। শনিবার ভোরে সন্দেহভাজন ৮ যুবককে আটক করা হয়।
পুলিশ জানায়, সি ই ব্লকের ১৬০ নম্বর বাড়ির তিনতলায় থাকেন ব্যবসায়ী অমরনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর পরিবার। শুক্রবার রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ তিনি চিকিত্সকের কাছে গিয়েছিলেন। বাড়িতে তখন তাঁর দুই মেয়ে, স্ত্রী ও পরিচারিকা ছিলেন। পৌনে আটটা নাগাদ তাঁর মেয়ে নম্রতা চক্রবর্তী কাজে বাইরে যাচ্ছিলেন। দরজা খুলে বেরোতেই ৭-৮ জন দুষ্কৃতী তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে সোফায় চেপে ধরে। প্রত্যেক দুষ্কৃতীর হাতে ছিল রিভলভার, ভোজালি ও ছুরি। অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা তাঁদের মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। অমরনাথবাবুর আর এক মেয়ে রিনিতার পিঠে ছুরি ও মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে একটি ঘরে নিয়ে যায়। একই ভাবে অমরনাথবাবুর স্ত্রীকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে কোথায় কী কী আছে, তা জেনে নেয় দুষ্কৃতীরা। ওই পরিবারের দাবি, ১০ ভরি সোনা, হিরে, নগদ টাকা, দামি ঘড়ি (তার মধ্যে একটির দামই ৫০ হাজার টাকা) এবং ৬টি মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। পালানোর আগে প্যান্ডেল বাঁধার কাপড় দিয়ে সকলের হাত বেঁধে দেয় দুষ্কৃতীরা। তার মধ্যে নম্রতার হাতের বাঁধন আলগা ছিল। তিনি বাঁধন খুলে ঘরের দরজা আটকে পুলিশে খবর দেন।
শনিবারও আতঙ্ক কাটেনি পরিবারের। নম্রতা বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম আর বাঁচব না। ওঁরা বলছিল, ‘তোদের শেষ করে দেব।’ সল্টলেকে এমন হতে পারে কখনও ভাবিনি।’’ অমরনাথবাবুর পাশাপাশি মেয়েরাও ব্যবসা দেখাশোনা করেন। অসুস্থতার জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে অমরনাথবাবু ওই সময়ে চিকিত্সকের কাছে যাচ্ছেন। নম্রতা বলেন, ‘‘কেউ নজর রেখেছিল, বাবা যে এই সময়ে বাড়িতে থাকছেন না। দুষ্কৃতীদের পাণ্ডা এবং আরও এক জনের মুখ খোলা ছিল। বাকি সকলের মুখ ঢাকা ছিল। সকলেরই পরনে ছিল টি-শার্ট, জিনস। খালি পা।’’ দুষ্কৃতীরা পেশাদার নয় বলেই অনুমান নম্রতাদের।
সি ই ব্লক কমিটির সম্পাদক অজিত দত্ত জানান, ব্লকে তিন জন নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ আরও সজাগ হলে ভাল হয়।’’ ঘটনাচক্রে ওই ব্লকটিও বিধাননগর পুরনিগমের মেয়র সব্যসাচী দত্তের ওয়ার্ডের অধীন। তিনি বলেন, ‘‘সল্টলেকে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়ানোর দিকে শুধু থানা স্তরে নয়, শীর্ষ কর্তাদেরও নজর দেওয়া প্রয়োজন।’’ বাসিন্দাদের এক অংশের বক্তব্য, সম্প্রতি সল্টলেকে পুলিশের রদবদল হয়েছে। ফলে কিছু দিন একটু সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তা বলে এ ভাবে ডাকাতির ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। ৭-৮ জন যুবক হাতে এত অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পুলিশ খেয়াল করছে না। তবে আর নজরদারি কোথায়, প্রশ্ন বাসিন্দাদের।
পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। সল্টলেকে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই ৮ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মিলেছে। দ্রুত অপরাধীরা ধরা পড়বে। নজরদারি রয়েছে। নজরদারি আরও জোরদার করা হবে।’’
এ দিকে, পুলিশ যাদের আটক করেছিল, তারাই ডাকাতিতে যুক্ত কি না, তা জানতে অমরনাথবাবুর পরিবারকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সূত্রের খবর, দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা যায়নি। পুলিশ দুষ্কৃতীদের ছবি আঁকাচ্ছে।