ব্রিগেডের সভামঞ্চ ঘিরে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।—নিজস্ব চিত্র।
রেকর্ডের আগেই যেন রেকর্ড। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বাঁধ ভাঙা সমাবেশ আছড়ে পড়েছে অনেক বারই। কখনও ইন্দিরা গাঁধীর জন্য, কখনও জ্যোতি বসুকে ঘিরে, আবার কখনও যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে। এক একটা সমাবেশ এক একটা প্রেক্ষিত থেকে মাইল ফলকে পরিণত হয়েছে। রেকর্ড তৈরি হয়েছে, রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু সমাবেশের আয়োজন পর্বেই এ যাবৎ কালের বৃহত্তম জমায়েতের নজির তৈরি হওয়ার বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত জল্পনা শুরু হওয়া এর আগের কোনও ব্রিগেড সমাবেশকে গিরে দেখা যায়নি।
গত ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে যে ভঙ্গিতে এই ব্রিগেড সমাবেশের কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন সেই ভঙ্গিই বলে দিয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনের আগে বাংলায় তৃণমূলের শক্তি প্রদর্শনের সমাবেশে পরিণত হতে চলেছে এই ব্রিগেড। প্রতিপক্ষকে দাবড়ানি দিয়ে রাজনীতি করায় যে তৃণমূল এখনও পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই তৃণমূল শক্তি প্রদর্শনে কোমর বেঁধে নামলে ব্রিগেড সমাবেশের চেহারাটা কী রকম দাঁড়াতে পারে, তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অসুবিধা হয় না। অতএব, ২০১৮-র ২১ জুলাই তারিখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণাই অনেককে বুঝিয়ে দিয়েছিল ২০১৯-এর ১৯ জানুয়ারি কলকাতা ভিড়ে টালমাটাল হতে পারে। কিন্তু, এই ব্রিগেড সমাবেশকে মোদী বিরোধী ঐক্যের সব চেয়ে বড় উচ্ছ্বাস এবং হুঙ্কার হিসাবে তুলে ধরতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বদ্ধ পরিকর। জল্পনা এখন তাই আর ভিড়ের রেকর্ড নিয়ে নয়। অন্য সব রেকর্ডকে কতটা পিছনে ফেলতে পারবে শনিবারের ব্রিগেড, জল্পনা এখন শুধু তা নিয়েই।
রাজ্যে এখন জেলার সংখ্যা ২৩। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের উত্তর ২৪ পরগনা হোক বা গৌরীশঙ্কর দত্তর নদিয়া, অনুব্রত মণ্ডলের বীরভূম হোক বা সৌরভ চক্রবর্তীর আলিপুরদুয়ার, শুভাশিস চক্রবর্তীর দক্ষিণ ২৪ পরগনা হোক বা অজিত মাইতির পশ্চিম মেদিনীপুর— তৃণমূলের যে জেলা কমিটিকেই লোক দেওয়ার টার্গেটের ব্যাপারেজিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, সেই জেলা কমিটিই জানাচ্ছে, লক্ষ্য লক্ষাধিক। সব ক’টা জেলা যদি গড়ে এক লক্ষ লোকও আনতে পারে, তা হলেই অবিশ্বাস্য নজির গড়ে ফেলবে মমতার এ বারের ব্রিগেড সমাবেশ।
ব্রিগেডে নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিনকে।—আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
আরও পড়ুন: মার্চের শুরুতেই লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করতে পারে কমিশন
নজির যদি তৈরি হয়, তা হলে শুধু ব্রিগেডের ঘাসে নয়, ব্রিগেডের মঞ্চেও এ বার তৈরি হবে। সমাবেশের আকারে যেমন শুধু ব্রিগেডকে নয়, গোটা কলকাতাকে উপচে দিতে চাইছে তৃণমূল, শনিবার ব্রিগেডের মঞ্চে নক্ষত্রের সমাহারে সে ভাবেই গোটা দেশের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কোহিমা— কোন রাজ্যের নেতা নেই, কোন প্রান্তের মহারথী আসছেন না! তেলঙ্গানার শাসক দল টিআরএস, ওড়িশার শাসক দল বিজেডি, কেরলের শাসক দল সিপিএম— এই তিন দলকে বাদ দিলে অবিজেপি বা বিজেপি বিরোধী শিবিরের প্রায় সব রথী-মহারথী শনিবারের ব্রিগেড সমাবেশে হাজির থাকছেন অথবা প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর নিয়ে বাংলায় নিজেদের রাজনৈতিক জমি ধরে রাখার স্বার্থে এ রাজ্যের কংগ্রেস এই ব্রিগেড সমাবেশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখারই পক্ষপাতী। কিন্তু সনিয়া-রাহুল। শনিবার মমতার মঞ্চে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। শুক্রবার কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী চিঠিও পাঠিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সে চিঠিতে বিজেপি বিরোধী ঐক্য সমাবেশের সাফল্য তো কামনা করা হয়েইছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। পূর্ণ বয়কটে একমাত্র বামেরাই। তবে তাতে এই ব্রিগেড সমাবেশ বিন্দুমাত্র ম্লান হওয়ার নয়। ব্রিগেডের একটা সমাবেশকে এ ভাবে জাতীয় রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্রে পরিণত হতেও অনেকগুলো প্রজন্ম দেখেনি।
এর আগে কোন কোন সময়ে নজর কেড়েছে ব্রিগেড?
প্রথম মাইল ফলক ১৯৫৫ সাল। তৎকালীন সোভিয়েত উইনিয়নের দুই শীর্ষ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিন ভারত সফরে এসেছিলেন। তাঁদের নিয়ে ব্রিগেডে জনসভার আয়োজন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তাৎপর্যে এবং জমায়েতে সে ব্রিগেড ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে চির কালের জন্য।
১৯৭২ সালে ব্রিগেডে ইন্দিরা গাঁধী।—আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
ব্রিগেডের ঐতিহাসিক তাত্পর্য নিয়ে প্রশ্নোত্তর: খেলুন কুইজ
এর পরে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ভেঙে গিয়েছে পাকিস্তান, ভারতের সহায়তায় এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিগেডে সমাবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। সে বারও আয়োজক ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। উচ্ছ্বাসে, উন্মাদনায় ভেসে গিয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড।
এর তিন বছর পরে আবার নজর কেড়েছিল ইন্দিরা বিরোধী এক ব্রিগেড। জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতি বসু, প্রফুল্ল সেনরা এক মঞ্চে এসেছিলেন সে বার। বাংলার তথা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেই সমাবেশ অবশ্যই এক মাইল ফলক ছিল।
১৯৯২ সালে এই ব্রিগেড থেকেই বামফ্রন্টের ‘মৃত্যু ঘণ্টা’ বাজানোর ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
আরও পড়ুন: শহরে তারকা সমাবেশ! ব্রিগেডে যোগ দিতে এলেন দেবগৌড়া, পওয়ার, অখিলেশ-সহ একঝাঁক নেতা
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় গোটা বাংলাকে চমকে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯২ সাল। বামফ্রন্ট তখন বাংলার মধ্যগগনে। ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা কংগ্রেসের ডাকে যে ব্রিগেড ভরতে পারে, এমনটা ভাবাই যাচ্ছে না। এমন এক সন্ধি ক্ষণে প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রিগেডে সমাবেশ ডাকলেন, বামফ্রন্ট সরকারের ‘মৃত্যু ঘণ্টা’ বাজানোর ডাক দিলেন। ২৫ নভেম্বরের সেই ব্রিগেড জমায়েত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ক্রাউড পুলার’ ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা তো দিয়ে ছিলই, কংগ্রেসকেও বাংলায় চনমনে করে তুলেছিল এক ধাক্কায়।
২৯ নভেম্বর বামেদের ব্রিগেড সমাবেশও আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। ২৫ নভেম্বর মমতার সাফল্য দেখার পরে সর্ব শক্তি দিয়ে ময়দানে ঝাঁপায় সিপিএম। কংগ্রেসের সমাবেশকে টেক্কা দেওয়ার জন্য বাংলার তদানীন্তন শাসক দল উঠেপড়ে লাগে। বামেদের সেই জমায়েত কিন্তু সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল রাজনৈতিক শিবিরের। ব্রিগেডে ভিড় জমানোর পরীক্ষায় বামেদের সেই জমায়েত সর্বকালীন রেকর্ড কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী কালে ২০০৬ সালেও ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে অবিশ্বাস্য জনস্রোত তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট।
বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশ।—ফাইল চিত্র।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পৌঁছে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড ফের এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে। শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র্যালি’র জন্য সেজেগুজে প্রস্তুত দেশের পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম শহরের সব চেয়ে বড় মাঠটা। ইতিহাস তৈরি হওয়ার আগেই আঁচ করা যাচ্ছে যে, রাত পোহালেই ইতিহাস তৈরি হবে কলকাতায়— এও কম বড় রেকর্ড নয়।