দুর্ঘটনা ঘটলে বা গাড়ি কিংবা মোটরবাইক ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত হলে নাম বদল ঘিরে এমন সব তথ্য সামনে আসে প্রায়ই। প্রতীকী ছবি।
ঘটনা ১: রাতে ইএম বাইপাসে পর পর দু’টি গাড়িতে ধাক্কা মেরে এক পথচারী ও এক সাইকেল আরোহীকে পিষে দিয়েছিল একটি গাড়ি। মৃত্যু হয় দু’জনের। স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন বছর একুশের এক মত্ত তরুণ। কিন্তু পুলিশ দেখে, গাড়িটি রয়েছে এক স্কুলশিক্ষকের নামে। তিনি মাস চারেক আগে গাড়ি কেনাবেচার একটি সংস্থাকে সেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নাম পরিবর্তন হয়নি।
ঘটনা ২: জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ি থেকে উদ্ধার হয় পা বাঁধা দু’টি গরু। সামনে আসে আন্তঃরাজ্য গরু পাচারের ঘটনা। গাড়িচালক ও খালাসির মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। পুলিশ দেখে, গাড়িটি আগের মাসেই একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছিল। জানা যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের এক বাসিন্দার নামে সেটি নথিভুক্ত। তিনি জানান, তিন মাস আগে গাড়িটি বারুইপুরে একটি পুরনো গাড়ির শোরুমে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। মালিকানা বদল হয়নি।
দুর্ঘটনা ঘটলে বা গাড়ি কিংবা মোটরবাইক ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত হলে নাম বদল ঘিরে এমন সব তথ্য সামনে আসে প্রায়ই। যেমন সামনে এসেছে, বর্ধমানের শক্তিগড়ে কয়লা ব্যবসায়ী রাজেশ ওরফে রাজু ঝা-র খুনের ঘটনায়। যে গাড়িতে অভিযুক্তেরা এসেছিল, সেটি পঞ্চসায়রের এক মহিলার। ওই ঠিকানায় তদন্তকারীরা পৌঁছলে মহিলার ছেলে জানান, গত সেপ্টেম্বরে একটি সংস্থাকে তাঁরা গাড়িটি বিক্রি করেন। বিক্রির টাকার মধ্যে ১০ হাজার বাকি রেখে জানানো হয়েছিল, নতুন মালিক পাওয়া গেলে খাতায়-কলমে মালিকানা পরিবর্তন করা হবে। কিন্তু, এত দিন পরেও মালিকানা পরিবর্তন হল না কেন, আর কী করেই বা গাড়িটি খুনের ঘটনায় অভিযুক্তদের হাতে পৌঁছল, ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের।
পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের বড় অংশই ‘রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অফিস’ (আরটিও) এবং ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অফিস’ (এআরটিও)-এর একটি চক্রের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ব্যক্তিগত ভাবে কেউ গাড়ি বা বাইক বিক্রি করলে তো কথাই নেই, কোনও সংস্থার মাধ্যমে বিক্রির পরেও মালিকানা বদলাতে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হয়। গাড়ি যত পুরনো, হাঁকা হয় তত বেশি টাকা। সোমবারই কসবা এআরটিও অফিসের এক জনকে ফোন করা হলে, তিনি নিজেই সবটা করিয়ে দেবেন বলে দাবি করে বলেন, ‘‘সব হয়ে যাবে। কিন্তু খরচ করতে হবে।’’ কত টাকা? তাঁর উত্তর, ‘‘বেশি নেব না। গাড়ির বয়স কত, তার উপরে নির্ভর করছে।’’ কিন্তু সরকারি হিসাবে কত লাগে? ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘দু’হাজারের আশপাশে। কিন্তু ওই টাকায় কি সবটা হয়!’’
অভিযোগ রয়েছে গাড়ি বিক্রির মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধেও। ভুক্তভোগীদের দাবি, বিক্রির যে দাম ওঠে, তার থেকে ১০ হাজার টাকা কেটে বাকিটা দেওয়া হয় বিক্রেতাকে। ওই ১০ হাজার টাকা বাকি থাকার কাগজ ধরিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। নিজেদের পছন্দ মতো দামে গাড়ি বিক্রির পরেই মালিকানা বদলের ব্যাপারে ভাবা হয়। তত দিন গাড়ি থাকে আগের মালিকের নামেই। বহু ক্ষেত্রেই অনেকটা দূরে গাড়ি বিক্রি করা হয়। আগের মালিক কলকাতায়, অথচ যাঁকে বিক্রি করা হল, তিনি হয়তো উত্তর দিনাজপুরে। দু’পক্ষই আরটিও অফিসে যেতে গড়িমসি করেন। সংস্থাগুলিরও উৎসাহ থাকে না। নতুন ক্রেতা পাওয়ার আগে যে সংস্থা গাড়িটি তুলে নিয়ে গেল, তারাই বা গাড়ি নিয়ে কী করছে, তা নিয়েও অভিযোগ বিস্তর।
পুলিশের দাবি, এ নিয়ে বার বার সতর্ক করা হয়েছে পরিবহণ দফতরকে। কিন্তু, পরিস্থিতি বদলায়নি। দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই সমস্ত রুখতেই সম্প্রতি নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। এ মাসের পয়লা তারিখ থেকেই গাড়ি বিক্রির মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলিকে সংশ্লিষ্ট আরটিও অফিস থেকে লাইসেন্স নিতে বলা হয়েছে। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তা নেওয়া বাধ্যতামূলক। পরিবহণ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘নাম বদল নিয়ে জটিলতা কাটাতেই এই নিয়ম। নিয়ম হয়েছে, যিনি গাড়ি বিক্রি করলেন, তাঁকে কোথাও যেতে হবে না। যে সংস্থা গাড়িটি তুলল, তারাই মালিকানা নেবে ও তার পরে বিক্রি করবে। এতে সংস্থাগুলি নিজেদের বাঁচাতেই নাম বদলের কাজে জোর দেবে।’’