মায়ের সঙ্গে সঞ্জীব। (ডান দিকে) চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক। ছবি:রণজিৎ নন্দী
দিন তিনি এখনও গুনছেন। তবে এ বার নতুন করে জীবন শুরুর অপেক্ষায়।
কিছু দিন আগেও অবশ্য বছর বত্রিশের যুবক একচিলতে ঘরে বসে শেষের দিন গুনতেন। অপেক্ষা করতেন, কবে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনের জবাব আসবে। কিন্তু এখন তিনি অপেক্ষা করছেন জীবনের নতুন ইনিংস শুরুর।
২০০৬ সালে অসমের তেজপুরের কাছে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন ইছাপুরের সঞ্জীব বর্ধন। মেরুদণ্ড ও ঘাড়ে গুরুতর চোট পাওয়ায় দেহের বহু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করছিল না। বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জীব। গত বছর ২৮ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর যন্ত্রণার কাহিনি।
ওই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরে সঞ্জীবের শুশ্রূষায় উদ্যোগী হন ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক। শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। এখন পার্ক সার্কাসের কাছে একটি বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁর থেরাপি চলছে। এই মুহূর্তে অনেকটাই সুস্থ সঞ্জীব।
মৌলিমাধববাবু জানান, দুর্ঘটনার পরে ওই যুবকের শরীরে কয়েকটি অস্ত্রোপচার হলেও অস্ত্রোপচার-পরবর্তী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হয়নি। অথচ, মেরুদণ্ডে আঘাত কিংবা স্নায়ুর চিকিৎসায় ‘রিহ্যাবিলিটেশন’ বা পুনর্বাসন জরুরি। গত প্রায় তিন মাস ধরে বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও ফিজিওথেরাপি করানোর মাধ্যমে দেহের অসাড় হয়ে যাওয়া স্নায়ুগুলির একাংশ ফের কাজ শুরু করেছে। চিকিৎসক জানান, রিহ্যাবিলিটেশনের ফলে এখন সঞ্জীবের স্নায়ুগুলি আবার জেগে উঠছে। কিছু স্নায়ুর কাজ এখনও বন্ধ থাকলেও ওঁর পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আশা শেষ হয়ে যায়নি।
সঞ্জীব যে আবার কাজে ফিরতে পারবেন, সেই আশা দিচ্ছেন মৌলিমাধববাবু। তবে ওই যুবকের হাতের আঙুলের কয়েকটি স্নায়ু এখনও ঠিক মতো কাজ করছে না। তাই দরকার কৃত্রিম হাত। যেটা কম্পিউটারে কাজ করার সময়ে সঞ্জীবকে পরে নিতে হবে। মৌলিমাধববাবু বলেন, ‘‘সঞ্জীব কোনও দিন নিজের হাতে কাজ করতে পারবেন না, সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। চেষ্টা চলছে। তবে, আপাতত উনি কৃত্রিম হাতের সাহায্যে কাজ শুরু করতে পারবেন।’’
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সঞ্জীবের এখনকার চিকিৎসায় খরচ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। যার অনেকটাই ওই বেসরকারি হাসপাতাল বহন করছে। হাসপাতালের সিইও জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একটি বেসরকারি হাসপাতালের পক্ষে এত ব্যয়বহুল চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু মানবিক দিক থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তবে সঞ্জীবের কৃত্রিম হাতের জন্য দরকার প্রায় চার লক্ষ টাকা। সেই জন্য সঞ্জীবের পরিবার মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য চেয়েছেন। পরিবারের পাশে রয়েছেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ হিসেবে আমি যতটা পারব, সঞ্জীবের পাশে থাকব। ওঁর পরিবারের লড়াইয়ে সঙ্গী হব।’’
তবে কি ওই যুবক স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন?
আসলে এখন ওই আবেদন সঞ্জীবের কাছে এক রকম অপ্রাসঙ্গিক। তাঁর কথায়, ‘‘বেঁচে থাকার মানে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে, নতুন ভাবে শুরু করার সময় এখনও শেষ হয়নি।’’
এ দেশে অবশ্য স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন গ্রাহ্য করা হয় না।
এ ক্ষেত্রে সঞ্জীব একা জীবনে ফেরেননি। জীবনের আলো গায়ে মেখেছেন ইছাপুরের এক বৃদ্ধ দম্পতিও। তাঁরা সঞ্জীবের বাব-মা তপন ও এবং বীথিকা বর্ধন। ছেলের অবস্থা দেখে নিজেরাও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছিলেন। তবে এখন তপনবাবু বললেন, ‘‘ছেলের বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ও যে ভাবে বেঁচেছিল, সেটা মরে যাওয়ার থেকেও বেশি কষ্টের। তবে এখন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে আমার ছেলে। সঙ্গে আমরাও।’’
সঞ্জীবের মা বীথিকাদেবীর কথায়, ‘‘ছেলের মুখে আবার কোনও দিন হাসি দেখব, সেই আশা করিনি। ওকে আবার হাসতে দেখে মনে হচ্ছে আমিই যেন বেঁচে উঠলাম।’’