পুজোর আওয়াজ থেকে বাঁচাতে কানে হেডফোন গুঁজেই প্রতিমা দর্শনে নিয়ে যেতে হয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছোটদের। —নিজস্ব চিত্র।
কয়েক জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন এক মহিলা। ফোনে কথা বলে যাওয়া হলেও মণ্ডপের সামনে পৌঁছনো মাত্র তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, পুজোর এখনও উদ্বোধন হয়নি। তাই প্রতিমা দর্শন এখনই সম্ভব নয়। অনুরোধ করা হয়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছোটদের নিয়ে আসা হয়েছে, প্রতিমা না দেখা গেলেও অন্তত মণ্ডপের সামনে ওদের যেতে দেওয়া হোক! এর পরে অনুরোধ করা হয়, ভিতরে ঢুকতে দেওয়ার দরকার নেই, সামনে থেকে দাঁড়িয়ে মণ্ডপ দেখতে পেলেই হবে! কিন্তু অভিযোগ, এত অনুনয়ের পরেও সেটুকু পর্যন্তও অনুমতি মেলেনি। এমন ভাবে মুখের উপরে গার্ডরেল টেনে দেওয়া হয় যে, যিনি বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মহিলার পায়ের উপর দিয়ে গার্ডরেলের চাকা চলে যায়!
সেই ঘটনার জেরে ভয় আর আতঙ্ক এমন ভাবে চেপে বসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ওই ছেলেমেয়েদের মনে যে, তাদের আর কোনও পুজোমণ্ডপেই নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সর্বজনীন পুজো থেকে বিচ্যুত হয়েই সে বার থাকতে হয়েছিল তাদের। কিন্তু এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশেষ ভাবে সক্ষমদের নিয়ে কলকাতার পুজো দেখাতে বেরিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। অভিযোগ, কোথাও বার বার অনুরোধ করেও আলাদা ভাবে প্রতিমা দর্শনের সুযোগ মেলেনি, ভিআইপি গেট থাকলেও সে পথে যেতে দেওয়া হয়নি। কোথাও আবার দর্শনার্থীদের তরফেই প্রবল চিৎকার শুরু হয়েছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য তাঁদের প্রতিমা দর্শনে অসুবিধা হচ্ছে— এই অজুহাতে। গত কয়েক বছরে এমন পরিস্থিতির বদল চেয়ে নানা মহল থেকে প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও সমালোচিত হয়েছে বহু বার। এর পরে লালবাজারের তরফে মণ্ডপ তৈরির সময়ে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের কথা মাথায় রাখার জন্য এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর) প্রকাশ করে নির্দেশ জারি করা হয়। কিন্তু তার পরেও এখনও বহু পুজো মণ্ডপে এ বিষয়ে সচেতনতা দেখা যায় না বলে অভিযোগ। যা প্রশ্ন তুলে দেয়, শিল্পের উৎকর্ষ ও অভিনবত্ব নিয়ে পুজো উদ্যোক্তারা যতটা চিন্তিত, এই মানবিক দিকটি নিয়ে কি ততটা নন?
বিশেষ ভাবে সক্ষমদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা জানাচ্ছেন, জনগণনা অনুযায়ী ভারতে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ বিশেষ ভাবে সক্ষম। অসুস্থতা ও দুর্ঘটনার জেরে আরও অনেকেই এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য আইন করে সরকারি চাকরিতে ৩ শতাংশ সংরক্ষণ, সন্তানদের দেখাশোনার জন্য অভিভাবকদের পাশে থাকার কথা বলা হয়। ১৯৯১ সালে দু’টি আইন হয়, বিশেষ ভাবে সক্ষম সন্তানদের পড়াশোনা ও পরিচর্যার সুবিধার্থে চাকরির জায়গা বেছে নেওয়ার ব্যাপারে। ১৯৯৫ সালে সমানাধিকার আইন চালু হয় বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য। সেই আইন পরে নতুন করে চালু হয় অটিজ়ম-সহ আরও অনেক প্রতিবন্ধ-ক্ষেত্রকে নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৩-এ এই আইন কার্যকর করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনজীবনে আজও তাঁরা কার্যত ব্রাত্যই রয়ে যাচ্ছেন বহু দিক থেকে। দীর্ঘদিন ধরে এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার প্রধান তথা রিহ্যাবিলিটেশন সাইকোলজিস্ট অমৃতা পণ্ডা বললেন, ‘‘বিশেষ ভাবে সক্ষমদের সাহায্য করা মানে শুধু হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা নয়, এটা বুঝতে হবে। পুজোর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট দিন শুধু ওদের জন্য দিলে খুব ভাল হয়।’’ পশ্চিমবঙ্গ অটিজ়ম সোসাইটির ডিরেক্টর ইন্দ্রাণী বসুরও একই দাবি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বহু বার দেখেছি, আমাদের কোনও বাচ্চা হয়তো হঠাৎ মণ্ডপের ভিতরে মাটিতে বসে পড়ছে! তখন পিছনের লোকেরা প্রচণ্ড রেগে চিৎকার করছেন। সমস্যা আছে বলার পরেও শুনতে হয়েছে, কই দিব্যি তো হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে! আসলে শারীরিক দিক থেকে বিশেষ ভাবে সক্ষমতার প্রমাণ দেখতে চান অনেকে।’’
কিন্তু এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে কেন? পুজো কমিটিগুলির তরফে ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সাধারণ সম্পাদক তথা হাতিবাগান সর্বজনীনের পুজো কর্তা শাশ্বত বসু বললেন, ‘‘সব পুজো কমিটিই যথাসম্ভব করার চেষ্টা করে। এখন সচেতনতা অনেক বেড়েছে।’’ কলকাতা পুলিশের কমিউনিটি পুলিশিং বিভাগের ওসি মানস ঝা বললেন, ‘‘কোথাও গাফিলতি থাকলেই দেখা হবে। বিশেষ ভাবে সক্ষম এবং বয়স্কদের এ বার চতুর্থী আর ষষ্ঠীতে পুজো পরিক্রমায় নিয়ে যাচ্ছি আমরা।’’
দমদম পার্কের বাসিন্দা, এক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা বললেন, ‘‘করোনার আগে এক বার ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে তিনটি মণ্ডপে ঢোকার চেষ্টা করেও পারিনি। শেষে একটিতে ঢুকতে পারলেও ছেলে বসে পড়ে। স্বেচ্ছাসেবক আর কিছু দর্শনার্থী সে দিন যে দুর্ব্যবহার করেছিলেন, তা ভোলার নয়। আর কখনও যাওয়ার সাহস হয়নি।’’ এর পরে তিনি বলেন, ‘‘সর্বজনীন দুর্গাপুজো, সর্বজনীন আর হল কই?’’