প্রশান্তি: মাকে ফিরে পেয়ে খুশি ছেলে। বুধবার, গার্ডেনরিচ থানার সামনে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
‘‘মেরা বেটা আয়া হ্যায়।’’ গার্ডেনরিচ থানায় ছেলেকে এক ঝলক দেখেই মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল বছর ষাটেকের আকবরি খাতুনের। আর এক যুগ পরে মাকে ফিরে পেয়ে ছেলে মহম্মদ কালাম ওরফে রাজু তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। বারো বছর পরে মা-ছেলের সেই সাক্ষাৎ চাক্ষুষ করতে গার্ডেনরিচ থানায় তখন অফিসারেরাও জড়ো হয়েছেন। ঠিক যেন সিনেমার গল্প।
সেই এক যুগ আগে মা ঘর থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। বহু খোঁজাখুঁজি করার পরে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন রাজু। মায়ের স্মৃতিই তখন একমাত্র সম্বল তাঁর। সেই মা ফিরে এসেছেন বারো বছর পরে।
গার্ডেনরিচের মাচিসকল এলাকার বাসিন্দা রাজু বললেন, ‘‘বুধবার দুপুরে গার্ডেনরিচ থানার এক অফিসার ফোন করে আমাকে বলেন, এক মহিলা এসেছেন থানায়। তিনি বোধহয় আপনার মা। থানায় এসে ওঁকে নিয়ে যান। কথাটা তখন আমার বিশ্বাস হয়নি। থানায় ছুটে গিয়ে দেখি, সত্যিই আমার মা!’’
রাজু জানান, বারো বছর আগে এক বকরি ইদের দিন তাঁর মা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘‘২০০৮ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মা মানসিক ভারসাম্য খানিকটা হারিয়ে ফেলেন। বাড়ি থেকে যখন তখন বেরিয়ে পড়তেন। কিন্তু আবার ফিরেও আসতেন। বকরি ইদের দিন মাকে যখন খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন ভাবলাম, কাছাকাছি কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছেন। ফিরে আসবেন। কিন্তু সাত দিন পেরিয়ে গেলেও মা বাড়ি ফিরলেন না।’’
রাজু জানান, এর পরে অনেক খুঁজেও সন্ধান পাননি মায়ের। শেষে হতোদ্যম হয়ে খোঁজখবর করাও আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেন। গার্ডেনরিচ এলাকায় একটি কাপড়ের কারখানায় মজুরের কাজ করেন রাজু। জীবন সংগ্রামের প্রবল চাপে মায়ের স্মৃতিও ফিকে হয়ে এসেছিল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন আকবরি? মানসিক ভারসাম্য হারানো প্রৌঢ়া সে ভাবে কোনও কথাই মনে করতে পারেন না। শুধু বললেন, ‘‘কলকাতা থেকে বর্ধমানে গিয়ে ট্রেনে চেপে কোথায় যেন চলে গেলাম।’’
গত বারো বছর ধরে আকবরি কোথায় কাটিয়েছেন, তার উত্তর ছিল গার্ডেনরিচ থানায় তাঁর পাশে দাঁড়ানো সমাজকর্মী লক্ষ্মীপ্রিয়া বিষয়ীর কাছে। লক্ষ্মীপ্রিয়া জানান, তাঁদের সংস্থা রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়েই কাজ করে। আকবরিকে তাঁর ছেলের কাছে ফিরিয়ে দিতে মুম্বই থেকে লক্ষ্মীপ্রিয়া ও তাঁর সঙ্গী স্মিতা এসেছেন কলকাতায়। লক্ষ্মীপ্রিয়া বললেন, ‘‘আমদাবাদে মানসিক ভারসাম্যহীনদের একটি হোম থেকে উদ্ধার করে ওঁকে বছর দেড়েক আগে মুম্বই নিয়ে যাই। উনি শুধু বলতে পেরেছিলেন, ওঁর বাড়ি কলকাতার মেটিয়াবুরুজের কামাল টকিজ়ে। ছেলের নাম রাজু।’’ লক্ষ্মীপ্রিয়া জানান, লকডাউনের জন্য গত বছর আকবরিকে নিয়ে কলকাতায় আসতে পারেননি। মুম্বই থেকে এ দিন কলকাতায় এসেই মেটিয়াবুরুজ থানায় আকবরিকে নিয়ে যান তাঁরা। থানা জানায়, কামাল টকিজ় এলাকা গার্ডেনরিচে। এর পরে গার্ডেনরিচ থানায় এসে পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে আকবরিকে কামাল টকিজ় এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওই এলাকায় আর থাকেন না রাজু। শেষ পর্যন্ত পুলিশই স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে রাজুকে ফোন করে থানায় ডেকে নেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া বলেন, ‘‘পুলিশের সাহায্য ছাড়া আকবরিকে তাঁর ছেলের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না।’’
দেড় বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন আকবরিকে ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিচর্যা লক্ষ্মীপ্রিয়াই করেছেন। একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। লক্ষ্মীপ্রিয়া বললেন, ‘‘কত ভারসাম্যহীন মানুষকেই তো বাড়ি ফিরিয়ে দিই আমরা। কিন্তু কিছু মানুষের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।’’ থানা থেকে বেরোনোর সময়ে আকবরির ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে রাজুকে লক্ষ্মীপ্রিয়া বললেন, ‘‘মাকে নিয়মিত ডাক্তার দেখাবেন। যত্ন নেবেন।’’