রায়ার স্মৃতির উত্তাপ অনেককে এখনও নতুন কাজের রসদ জোগাচ্ছে
ঝকঝকে ছাপা অক্ষরে সে লিখছে কখনও বাড়ি না-ফেরা নাজিবের কথা, ঠিক পাশেই ছবিতে খুব রোগা তরুণ বাবার কোলে মহামিষ্টি আহ্লাদী রায়া।
কিংবা আর্জেন্টিনায় গর্ভপাত অধিকার নিয়ে টানাপড়েনের লেখায় ছবিতে কলকাতার রাস্তায় পুলিশকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রঙের টিন হাতে রাজনৈতিক স্লোগান আঁকছে রায়াই।
ডিজিটাল প্রিন্টের রংচঙে উজ্জ্বল বইখানার ছত্রে ছত্রে এমন অজস্র বাঙ্ময় লেখা ও ছবি। তাতে নিরন্তর মুহূর্তের জন্ম হয়ে চলেছে। তবু বইটার কেন্দ্রে থাকা মেয়েটা এ ভাবে ছাপানো ছবি বা লেখাতেই মিশে থাকবে এটা হজম করা এখনও কঠিন তার প্রিয়জনের জন্য। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে রায়ার চলে যাওয়া ঠিক সহনীয় ঘটনাও নয়। এই শরতে শহর কলকাতার কোনও এক উচ্ছল রাজনীতিমনস্ক তরুণী তবু কয়েকটি ছবি বা শব্দ হয়েই তাঁর প্রিয়জনদের কাছে ফিরে আসছেন। সদ্যপ্রয়াত রায়া দেবনাথকে নিয়ে একটা বই আকস্মিক শোকের ধাক্কায় টালমাটাল হয়নি। শোক ছাপিয়ে জীবনের উদযাপনই হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: কোভিড আক্রান্ত গৃহকর্তা, কাজ করতে না চাওয়ায় বেতন না দেওয়ার হুমকি, থানায় গেলেন পরিচারিকা
গার্ডেনরিচের রাজনীতি মনস্ক পরিবারের মেয়ে রায়া মানে অনেকের কাছেই কলকাতার নানা প্রতিবাদ আন্দোলন ধর্নার একটা মুখ। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদ, হোক কলরব বা দিল্লিতে শ্রমিক সংহতির মিছিল, নানা অনুষঙ্গে মিশে তাঁর উপস্থিতি। নেপালে ভূমিকম্পের পরে বিপদ মাথায় নিয়ে সেখানে চলে গিয়েছিলেন রায়া। আবার এই ফেব্রুয়ারিতে দাঙ্গাধ্বস্ত দিল্লিতে নির্লজ্জ সংখ্যালঘু বৈষম্যের সময়েও মুস্তফাবাদ-ব্রিজপুরায় গিয়ে বিপন্নদের পাশে দাঁড়াতে তিনি অকুতোভয়। রায়ার বইয়ে এ সব গল্পও উঠে এসেছে।
আপাতভাবে যা ফেসবুকের রাগী পোস্ট, তার মধ্যেও মিশে সমকাল নিয়ে সচেতন নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি। বইয়ের পাতা জুড়ে দেশবিদেশে কাছের দূরের নানা ঘটনা নিয়ে রায়ার হাসি, রাগ, অভিমানের বর্ণমালা। দেশকাল নিয়ে এই যুগের একটি মেয়ের অভিজ্ঞানও মূর্ত। গার্ডেনরিচে বন্ধ কারখানায় লাল পতাকা হাতে শ্রমিক আন্দোলনের মুখ পোদ্দার প্রজেক্টের আশরফি চাচা, আজিজ জেঠুদের গল্পের পাশেই রয়েছে নিউ ইয়র্কে ট্রাম্পবিরোধী মিছিলে থাকার অভিজ্ঞতা। রায়ার ভাবনার অভিযাত্রায় এ দেশে শ্রম কোড, ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিল নিয়ে কাটাছেঁড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়েই রয়েছে অজস্র ছবি, বন্ধুদের পোর্ট্রেট বা ক্যারিকেচার, এবং রংবেরঙের কার্টুন চরিত্র। চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগেও তো এমন সব ছবিতেই রায়া বাড়ির দেওয়াল, বন্ধুদের 'ফেসবুক ওয়াল' ভরিয়ে দিয়েছিল।
বইটিতে বিভিন্ন বাম সংগঠনের বিবৃতি বা বিভিন্ন আন্দোলনের সূত্রে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে রায়ার বন্ধু, সহযোদ্ধাদের লেখা রয়েছে। আর রায়ার গুচ্ছের লেখা, ছবি নিয়ে চর্চার উপলক্ষ রায়ার কাছের জনদের কারও কারও জন্যও এই আকস্মিক শোকের সঙ্গে একটা আপাত রফাসূত্র হয়ে উঠেছে। অমৃত পৈড়া,শমীক চক্রবর্তী, শ্রীরূপা মান্না, সমাপ্তি সরকার, সঞ্জয় পাঠক, রূপকথারা এই স্মরণিকাটির সঙ্কলন,সম্পাদনা, প্রকাশনায় শামিল হন। রায়া যার 'পিকুপিসি' সেই ক্লাস সেভেনের বিহু বা রূপকথা এই দলের সব থেকে খুদে সদস্য। পিকুপিসিকে নিয়ে বইয়ের প্রুফ খুঁটিয়ে দেখা বিহুর ক্ষতেও একটা আকস্মিক প্রলেপ দিয়েছে। এবং রায়ার বইটিতে মিশে রয়েছে নানা আন্দোলনের মাঠের সাথী বন্ধু বা তাঁর কাছের জনেরা ধর্ম, ভাষা, যৌনতা নিয়ে ভিন্নতাও যাঁদের আলাদা করতে পারেনি।
আরও পড়ুন: পুজোর করোনা ঠেকাতে মানুষের ‘সদিচ্ছা’ই এখন ভরসা পুলিশের
লিঙ্গসাম্য, বামপন্থা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লড়াইয়ে ছোটখাটো চেহারার যোদ্ধা আনন্দবাজার ডিজিটালের প্রাক্তন কর্মী রায়া দেবনাথ অনেকের থেকে আলাদা ছিলেন আবার অনেকের মতোও। তবে তাঁর স্মৃতির উত্তাপ অনেককে এখনও নতুন কিছু কাজের রসদ জোগাচ্ছে। টালাব্রিজের নীচের ঝুপড়ি থেকে পাশেই রেলের জমিতে সাময়িক পুনর্বাসন পেয়েছেন যে মানুষগুলো তাঁদের অনেকেরও পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন রায়া। ওই মানুষগুলোর ডেরায় নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য এখন তৈরি রায়ার পাঠশালা। সেই তল্লাটের ছোটদের পুজোয় পোশাক দিয়েছেন রায়ার বন্ধুরা। সে-দিন গিয়েছিলেন রায়ার মা-বাবা আলপনা দত্ত, কুশল দেবনাথও।
মলিন দেওয়ালের চিলতে খোপ ভরে রায়ার আঁকা ছবিতে এখন সেজেছে পাঠশালা। জানলার ধারে সঙ্গী বেড়ালকে নিয়ে বসে রায়ার দিগন্ত ছোঁয়ার স্বপ্ন, মিছিলের স্রোত এ সবই সেদিন অনেককে ভরসা জোগাল, একদিন পৃথিবীতে ঘৃণা শেষ হবে। সেই ছবির নীচে খুদেদের কলকলানি মাতিয়ে রাখল সবাইকে। রায়ার বইয়ের শিরোনাম 'রয়ে গেল রায়া' তখন সত্যি হয়ে উঠেছে।