হোমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো একটি গাড়ি। কিছুতেই তা থেকে নামতে চাইছিল না দশ বছরের ছেলেটা। তখনও তার ভয়, টিভি ভাঙার জন্য মা-বাবা খুব বকবে। আর দাদার কোলে তখন মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সাত বছরের ভাই। কিন্তু, টানা তিন দিন পরে দুই ছেলেকে ফিরে পেয়ে তখন চোখের জল সামলাতে পারছিলেন না তাদের বাবা-মা।
শেষমেশ পরিচিতদের থেকে ভরসা পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে মায়ের কাছে এগিয়ে এল দশ বছরের সুব্রত। মাথা নিচু করে বলল, ‘আর কোনও দিন করব না।’ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন মা মামণি মণ্ডল। আর এর মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে বাবা-মাকে সামনে দেখে ফের দুষ্টুমি শুরু করে দিল সাত বছরের তাপস।
গত শনিবার সকালে কার্টুন দেখা নিয়ে খুনসুটির জেরে টিভি ভেঙে ফেলেছিল সুব্রত ও তাপস। তার পরেই মা-বাবার বকুনির ভয়ে তাপসের পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেই তাকে পিঠে চাপিয়ে বাড়ি থেকে চম্পট দিয়েছিল সুব্রত। এ দিক-ও দিক ঘোরার পরে শেষমেশ কৃষ্ণনগর স্টেশনের কাছে দুই খুদের পথ আটকায় রেল রক্ষী বাহিনী। সেখান থেকেই তাদের স্থান হয়েছিল চাইল্ড লাইনে। গত সোমবার বিকেলে সেখান থেকেই দুই ভাইয়ের উদ্ধারের খবর আসে বালি থানায়। এর পরে মঙ্গলবার সকালেই কৃষ্ণনগরে হাজির হন সুব্রত ও তাপসের বাবা, মা ও পরিজনেরা। দুপুরে নদিয়া শিশুকল্যাণ সমিতি থেকে দুই ভাইকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এ দিন সুব্রত তার আত্মীয়দের জানিয়েছে, টিভি ভাঙার পরে সে ভয় পাচ্ছিল মা বোধ হয় তাকে খুব বকবে, মারবেও। সে কারণে ভাই তাপসের পায়ে চারটে সেলাই থাকলেও ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেই তাকে পিঠে চাপিয়ে খালি পায়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সে। উদ্দেশ্য ছিল ক্যানিংয়ে ঠাকুরমার বাড়িতে গিয়ে ওঠার। কিন্তু রাস্তা না চেনায় সব গোলমাল হয়ে যায়।
চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া সুব্রত শুধু এটুকু জানত, ঠাকুরমার বাড়ি যেতে গেলে ট্রেন ধরতে হয়। সেই মতো বালি স্টেশন থেকে ট্রেনেও চেপেছিল দুই খুদে। বারুইপাড়া স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মেই বসে ছিল। তাপসের পায়ে ব্যান্ডেজ, খালি গা আর সুব্রতর আলুথালু পোশাক দেখে অনেকের করুণা হয়। তাঁরাই দুই ভাইকে কিছু পয়সা দিয়েছিলেন। সেই দিয়েই আইসক্রিম কিনে নিজে ও ভাইকে খাইয়েছিল সুব্রত। এর পরে ট্রেন ধরে সোজা শিয়ালদহ। কিন্তু সেখান থেকে ফের ভুল ট্রেনে উঠে তারা শনিবার রাতে পৌঁছে যায় কৃষ্ণনগরে। স্টেশনে দুই খুদেকে ঘুরতে দেখে আটক করে আরপিএফ। এর পরেই স্থানীয় থানার মাধ্যমে দু’জনে চাইল্ড লাইনের হেফাজতে যায়।
বাড়ি ফেরার জন্য মঙ্গলবার দুপুরে গাড়িতে ওঠার সময়ে বাবা-মায়ের কোলে চেপে দুই খুদে অবশ্য দাবি করেছে, ‘আর বদমায়েশি করব না। টিভি ভাঙব না। বকবে না তো?’