বছর শুরুতে শহরে ভোটের ভাবনা

নির্ধারিত সময়ের আগেই কলকাতায় পুরভোট করাতে চায় রাজ্য সরকার। নবান্ন সূত্রে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। পুরসভা সূত্রেও খবর, আগামী জানুয়ারি মাসে ভোট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্যের আরও কয়েকটি পুরসভার সঙ্গেই ভোট হবে কলকাতায়। আগাম ভোটের জল্পনা উস্কে ঘটনাচক্রে কাল, সোমবার কালীঘাটে নিজের বাড়িতে কলকাতা পুরসভা নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরসভার মেয়র পারিষদ, বরো কমিটির চেয়ারম্যান, কলকাতার সাংসদ-বিধায়ক এবং দলের শীর্ষ নেতাদের ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৮
Share:

নির্ধারিত সময়ের আগেই কলকাতায় পুরভোট করাতে চায় রাজ্য সরকার। নবান্ন সূত্রে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। পুরসভা সূত্রেও খবর, আগামী জানুয়ারি মাসে ভোট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্যের আরও কয়েকটি পুরসভার সঙ্গেই ভোট হবে কলকাতায়।

Advertisement

আগাম ভোটের জল্পনা উস্কে ঘটনাচক্রে কাল, সোমবার কালীঘাটে নিজের বাড়িতে কলকাতা পুরসভা নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরসভার মেয়র পারিষদ, বরো কমিটির চেয়ারম্যান, কলকাতার সাংসদ-বিধায়ক এবং দলের শীর্ষ নেতাদের ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। দলীয় সূত্রে খবর, বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পুরভোটের আগে কী ভাবে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যায়, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।

২০১০ সালে কলকাতা পুরসভার ভোট হয়েছিল ৩০ মে। সেই হিসেবে ২০১৫-র মে-জুন মাসে ফের ভোট হওয়ার কথা। কিন্তু সেই ভোট মাস চারেক এগিয়ে আনার তৎপরতা কেন? বিশেষ করে যখন সেপ্টেম্বরে মেয়াদ শেষ হলেও ১৭টি পুরসভার ভোট করাতে চায়নি রাজ্য সরকার। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিবাদের পরে আদালতের দ্বারস্থ হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। জানুয়ারি মাসের মধ্যে ভোট করা হবে বলে আদালতে জানিয়েছে রাজ্য।

Advertisement

সেই ভোট পিছনোর কারণ হিসেবে রাজ্য প্রশাসন এবং তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছিল, লোকসভা ভোটে গোটা রাজ্যে যে ভাবে বিজেপির উত্থান হয়েছে, তাতে ঠিক তার পরেই পুরভোট করানোর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না মমতা। তিনি মনে করছেন, কিছু সময় গেলে মোদী-হাওয়া স্তিমিত হয়ে আসবে। কিন্তু ঘটনা হল, সময়ের সঙ্গে রাজ্যে আরও চাঙ্গা হয়েছে বিজেপি। বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতেছেন তাদের প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য। কলকাতায় চৌরঙ্গি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও কংগ্রেস, সিপিএম-কে পিছনে ফেলে দু’নম্বরে উঠে এসেছে বিজেপি। এই অবস্থায় তৃণমূল নেতৃত্বের বড় অংশ মনে করছেন, সারদা থেকে শুরু করে জঙ্গি-যোগ, যাদবপুর থেকে শুরু করে ভাঙড় একের পরে এক ঘটনায় জড়িয়ে যে ভাবে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করেছে, তাতে যত সময় যাবে, ততই ফল আরও খারাপ হবে। কলকাতা পুরভোট এগিয়ে আনার উদ্যোগ এই ভাবনারই ফসল।

কিন্তু জানুয়ারিতে ভোট করার কথা ভাবা হচ্ছে কেন? পুর দফতরের এক অফিসারের ব্যাখ্যা, “বনগাঁয় তৃণমূল সাংসদের মৃত্যু হওয়ায় সেখানে ৬ মাসের মধ্যে উপনির্বাচন হবে। বসিরহাটের মতো বনগাঁতেও বিজেপি ভাল ফল করলে তার প্রভাব পড়বে কলকাতার পুরভোটে। তাই বনগাঁর উপনির্বাচনের আগেই কলকাতার ভোট সেরে নিতে চায় তৃণমূল সরকার।”

ওই আধিকারিক জানান, বনগাঁর উপনির্বাচনের দিন ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন। সেটা কবে হবে, তা জানাও রাজ্যের পক্ষে দুষ্কর। তাই বেশি দিন অপেক্ষা করা ঝুঁকির কাজ হবে। তার উপর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ পরীক্ষার মাস। এপ্রিলে বনগাঁর উপনির্বাচন ঘোষিত হলে সেই একই সমস্যা। এ সব ভেবেই জানুয়ারিতে কলকাতা পুরভোট করার চিন্তা করছে সরকার।

পুরভোট দোরগোড়ায় ধরে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে পুর প্রশাসনেও। শুক্রবার হঠাৎই ডাকা মেয়র পারিষদের বৈঠকে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কথাতেও তার আভাস পেয়েছেন পুর অফিসারেরা। তাঁদের কথায়, “সরকারের দেওয়া ১৫৫ কোটি টাকা খরচ করার জন্য যে ভাবে তাড়া দেওয়া হচ্ছে, তাতে ভোট আর দূরে নেই।” পুরসভার জঞ্জাল অপসারণ দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, ওই টাকা খরচ করতে দ্রুত টেন্ডার প্রক্রিয়া চালু করতে বলেছেন মেয়র। তাঁর কথায়, “এক কোটি টাকার উপরে কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া করতে সময় লাগে কমপক্ষে ১৫ দিন। এ বার মেয়রের নির্দেশ, ১২ দিনেই তা করে ফেলুন।” অন্য কাজের ক্ষেত্রেও টেন্ডার প্রক্রিয়ার সময় কমাতে বলা হয়েছে। এবং জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে ১৫৫ কোটি টাকার যাবতীয় কাজ।

তৃণমূল সরকারি ভাবে অবশ্য কলকাতার পুরভোট এগিয়ে আনার খবর স্বীকার করছে না। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শনিবার দাবি করেন, ভোট নির্ধারিত সময়েই হবে। কিন্তু মে মাসের ভোটের জন্য নভেম্বরের গোড়ায় বৈঠক ডাকতে হচ্ছে কেন, সেই প্রশ্ন থাকছেই। বিশেষ করে যখন দলীয় নেতাদের একটা বড় অংশের ধারণা, পুরভোটে প্রার্থী বাছাই কী ভাবে হবে, তার প্রক্রিয়া স্থির করতেই এই বৈঠক ডেকেছেন নেত্রী। পার্থবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, গত লোকসভা ভোটের নিরিখে দলের অবস্থান পর্যালোচনা, প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের খতিয়ান ইত্যদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে সোমবারের বৈঠকে।

গত লোকসভা ভোটে কলকাতার ২৬টি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে ছিল। তার পর যত দিন যাচ্ছে, ততই পায়ের তলার মাটি আলগা হচ্ছে তৃণমূলের। যার বড় কারণ, শাসক দলের পুরপ্রতিনিধিদের একটা বড় অংশ আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত, সাধারণ মানুষের মনে এমন ধারণা তৈরি হওয়া। বস্তুত, বহু তৃণমূল কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেই প্রোমোটারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, সিন্ডিকেট ব্যবসায় মদত দেওয়া-সহ নানা অভিযোগ উঠেছে। জমি নিয়ে গোলমালে জড়িয়ে ধাপা মাঠপুকুর এলাকার কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাউ এখনও জেল হাজতে। গার্ডেনরিচে হরিমোহন কলেজে ছাত্র সংসদের ভোটের গোলমালে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরী খুনের ঘটনায় স্থানীয় বরো কমিটির তৃণমূলের চেয়ারম্যান শেখ মুন্নাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান।

এই পরিস্থিতিতে এ বারের ভোটে ভাবমূর্তির নিরিখেই প্রার্থী বাছাই করা হবে বলে তৃণমূল নেতাদের দাবি। উদাহরণ দিতে গিয়ে দলের এক প্রথম সারির নেতা বলেন, “ধরা যাক, এক জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে আর্থিক-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হবে গত পাঁচ বছরে তাঁর সম্পত্তি বেড়েছে কি না, বা দেখা হবে তাঁর আয়-ব্যয়ের সমতা রয়েছে কিনা।” ওই নেতা জানান, ভোটে দাঁড়াতে গেলে যেমন নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসেব জানাতে হয়, এ বার মনোনয়নের সময়ে দলীয় নেতৃত্বের কাছেও তা দাখিল করতে হবে।

কিন্তু এই দাওয়াইয়ে কাজ হবে কি না, তা নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূল নেতাদের অনেকের কথায়, “বেআইনি পথে তৈরি করা সম্পত্তি তো কেউ নিজের নামে রাখে না! ফলে সেই হিসেব নিয়ে লাভ কী হবে? কিন্তু পাঁচ বছরে কে কত পয়সা, কী ভাবে করেছেন, সেটা তো এলাকার মানুষের জানা। সে ক্ষেত্রে তেমন লোককে প্রার্থী করলে তো হিতে বিপরীত হবে!”

দলের বড় অংশের মতে, শুদ্ধকরণের কথা বলাটা আসলে একটা প্রচার। সেই প্রচারটাকে সামনে নিয়ে আসার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে এই কারণেই যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা তুলেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। কিন্তু বাস্তবে প্রার্থী বাছাই হবে এলাকায় তাঁর প্রভাবের বিচার করেই। কে কতটা স্বচ্ছ, তার নিরিখে নয়। কারণ, “সম্পত্তির হিসেব দেখতে চাইলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের দশা হবে,” মন্তব্য এক তৃণমূল নেতার।

বিরোধী নেতারাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রশ্ন, “গোটা দলটাই আর্থিক দুর্নীতিতে ঠাসা। সেখানে কে কার দুর্নীতি ধরবে?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও তির্যক মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল এখন দুর্নীতির ড্রেন! সেখানে স্বচ্ছতা আনতে হলে দিদিমণিকে (তৃণমূল নেত্রী) তো রাজহংসী হতে হবে!”

পরামর্শ রাজ্যপালের

মাখড়া-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছু পরামর্শ দিলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তাঁর পরামর্শ মেনে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল। শনিবার কলকাতায় একটি সংবাদপত্র গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান শেষে এ কথা বলেন তিনি। শনিবার রাজ্যপালকে প্রশ্ন করা হয়, মাখড়া গ্রামে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে রাজ্য সরকারকে আপনি কি কোনও পরামর্শ দেবেন? জবাবে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীকে কিছু পরামর্শ দিয়েছি। আশা করছি, সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।” একই সঙ্গে তিনি জানান, মাখড়া গ্রামে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার কথাও তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement