Ariadaha Incident

‘দাদা’রা তাঁর কথা কিছুই নাকি জানতেন না! পুরসভা ‘জায়ান্ট’-এর অট্টালিকার নকশা অনুমোদন করেনি

দিনের আলোয় পুকুরের পাড় ঘেঁষে তিনতলা অট্টালিকা গড়ে উঠলেও তা পুরসভার অগোচরে থাকল কী করে? তা হলে কি ‘জায়ান্ট’-এর দাপটের সামনে নির্বিকার ছিলেন পুর কর্তৃপক্ষ?

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪ ০৮:০৮
Share:

জয়ন্তের অট্টালিকা। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

আড়িয়াদহের ‘ত্রাস’ জয়ন্ত সিংহের অট্টালিকা তৈরি হয়েছিল কী ভাবে? সেই প্রশ্নে অবশেষে মুখ খুলল কামারহাটি পুরসভা। জানিয়ে দেওয়া হল, সেটি ‘অবৈধ’। পুরসভার তরফে ওই অট্টালিকার কোনও নকশা (প্ল্যান) অনুমোদন করা হয়নি।

Advertisement

দিনের আলোয় পুকুরের পাড় ঘেঁষে তিনতলা অট্টালিকা গড়ে উঠলেও তা পুরসভার অগোচরে থাকল কী করে? তা হলে কি ‘জায়ান্ট’-এর দাপটের সামনে নির্বিকার ছিলেন পুর কর্তৃপক্ষ? প্রশ্ন পিছু ছাড়ছে না। বৃহস্পতিবার কামারহাটির পুরপ্রধান গোপাল সাহা বলেন, “ওই বাড়ি তৈরির কোনও অনুমোদন পুরসভা দেয়নি। জমিটিরও কোনও রেকর্ড পাওয়া যায়নি।” কিন্তু কামারহাটি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আড়িয়াদহ এলাকার প্রতাপ রুদ্র লেনে এই বাড়ি তো আর রাতারাতি ওঠেনি। তা হলে পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারেরা কী করছিলেন? গোপালের দাবি, “প্রতিটি ওয়ার্ডের কোথায় কী হচ্ছে, তা আমার একার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিককেও নোটিস দেওয়া হবে।”

যদিও স্থানীয়দের অভিযোগ, গোটা আড়িয়াদহেরই নির্মাণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করত জয়ন্ত-গ্যাং। যার নেপথ্যে ছিল শাসক দলের স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদত। তাই জয়ন্তের বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তোলা তো দূর, বরং বাড়ির কাজে মদত দেওয়া হয়েছিল। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি স্বপন মণ্ডল বছর দেড়েক আগে মারা গিয়েছেন। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, তার পর থেকে ‘জায়ান্ট’ ছিল অলিখিত পুরপ্রতিনিধি। তাই নিজের বাড়ি তো বটেই, আড়িয়াদহের সমস্ত বেআইনি নির্মাণই ‘ছাড়পত্র’ পেত জয়ন্তের অঙ্গুলি হেলনে। অভিযোগ, প্রাসাদোপম তিনতলা বাড়ি তৈরিতেও জয়ন্ত ব্যবহার করেছিল তার নিজস্ব সিন্ডিকেটকে। অর্থাৎ বিভিন্ন নির্মাণের জায়গা থেকে কার্যত ‘ফ্রি’-তে ইমারতি দ্রব্য নিজের বাড়ি তৈরির কাজে লাগিয়েছিল আড়িয়াদহের ‘বাহুবলী’।

Advertisement

ওই বাড়ির সামনের চত্বরে রাখা আছে দামি গাড়িও। ক্রমশ প্রকাশ্যে আসা জয়ন্তের নানা ছবিতে সেই গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রাজ্য পরিবহণ দফতরের নথি বলছে, গাড়ির মালিক জয়ন্তের শাগরেদ সৈকত মান্না ওরফে জঙ্ঘা। যে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। ২০২২ সালে এত দামি গাড়ি অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে সৈকত কিনল কী ভাবে? সূত্র বলছে, গাড়িটি শাগরেদের নামে কেনা হলেও মাসিক কিস্তির টাকা দিত জয়ন্ত।

স্থানীয় সূত্রের খবর, শেষ পাঁচ-ছ’বছরে জয়ন্ত থেকে ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠার পথে, স্থানীয় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের বেছে নিত ওই দুষ্কৃতী। কী ভাবে? সূত্র বলছে, প্রথমে নিজে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করলেও পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেট বানিয়েছিল আড়িয়াদহের ‘ত্রাস’ জয়ন্ত। আর সেই সিন্ডিকেটেই কাজ করত ৫০-৬০ জন যুবক। তাদের এক-এক জনকে একটি বা দু’টি করে প্রোমোটিংয়ের জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হত। সেখানে বালি, সিমেন্ট সরবরাহ করত তারা। সামগ্রীর গাড়ি পিছু ১০-১৫ হাজার টাকা করে নিজেদের লাভ রাখত ওই যুবকেরা।

এক প্রোমোটারের কথায়, “একটা জায়গায় পাঁচ গাড়ি বালি বা সিমেন্ট ফেলার অর্থ অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয়। ২০ দিনে সেই টাকা দিতে হত। তার পরে আবার মালপত্র ফেলত।” হিসাব বলছে, দেড় মাসে এক-এক জন যুবকের আয় দাঁড়াত এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। তাই ‘জায়ান্ট’-এর সাম্রাজ্যের ‘সৈন্য’ও ক্রমশ বাড়ছিল। এর বাইরে আরও ১০০-১৫০ জন যুবককে জয়ন্ত বিলাসিতার প্রলোভন দেখিয়ে কব্জায় রেখেছিল। এই সব শাগরেদদের আড্ডা থেকে ‘আদালত’, সবই চলত তালতলা ক্লাবের ভিতরে।

সূত্রের দাবি, সিন্ডিকেটের যুবকেরা মিলে প্রতি মাসে ক্লাব তহবিলে হাজার দশেক টাকা করে জমা রাখত। কেউ কেউ ‘বাহুবলী-দাদা’-র বদান্যতায় এলাকায় নিজের মতো ‘তোলা’ তুলত। আড়িয়াদহের গঙ্গা থেকে যে বালি তোলা হত, তাদের কেউ কেউ তাতে গাড়ি পিছু হাজার পাঁচেক করে পেত। পুলিশি ধরপাকড়ের পরে প্রায় এক বছর বালি তোলা অবশ্য বন্ধ।

এখন জয়ন্তের বিরোধী বলে পরিচিতদের অনেকেরই অভিযোগ, শাগরেদদের লাভের অংশ সরাসরি না নিলেও, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে ‘খুশি’ রাখতে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে তা খরচের নির্দেশ যেত জয়ন্তের থেকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলেরও একই অভিযোগ। এলাকার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “জয়ন্তের মতো আরও অনেককেই মদন ও সৌগত রায়ের প্রচারে দেখা গিয়েছে। জয়ন্তের বাহিনী পুরসভা ভোটে ৮, ১১ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভোট লুট করেছিল। বোঝাই যাচ্ছে, ওই দুষ্কৃতীর মাথায় কার হাত রয়েছে।” বিধায়ক মদন মিত্র অবশ্য বলেন, “বিরোধীরা একজোট হয়ে এ সব করাচ্ছে।” শাসক দলের একাংশও গোপনে বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে দাবি করে মদন বলেন, “প্রোমোটারদের নিয়ে আমি চলি না। বরং আড়িয়াদহের গুন্ডারাজের বিরুদ্ধে মুখ খুলছি বলে আমাকেই গুলি খাওয়ার হুমকি শুনতে হচ্ছে।” আর সৌগত বলছেন, “জয়ন্ত চিহ্নিত দুষ্কৃতী। এর আগে ধরা পড়লেও কী ভাবে জামিন হয়েছিল জানি না। আমি কোনও গুন্ডাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরি না। তার বাড়িতেও যাই না।”

নেতারা সবাই ‘জয়ন্ত-বিরোধী’ হলে দুধবিক্রেতা থেকে ‘জায়ান্ট’ হয়ে উঠল কী ভাবে সে? প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement