‘অচ্ছে দিনের নয়, তৈরি হচ্ছে হামলার ব্লু-প্রিন্ট’

ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন, যে ভাবে মুখে কাপড় বেঁধে, হাতে লাঠি নিয়ে হস্টেলে ঢুকে হামলা চালানো হয়েছে তা পূর্ব পরিকল্পিত না হলে সম্ভব নয়।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২০ ০২:৫২
Share:

হামলাকারীদের একটি দল।—ছবি পিটিআই।

শিক্ষাঙ্গনে হামলা নতুন কিছু নয়। ছাত্র-সংঘর্ষ, ভাঙচুর— নতুন নয় তা-ও। কিন্তু জেএনইউ-এর হামলা অতীতের সব হামলার থেকে ‘আলাদা’। তার চরিত্র সম্পূর্ণ পৃথক। এই হামলা শুধু সংগঠিতই নয়, হামলার ধরন দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এর ছক তৈরি হয়েছিল বহু আগে। এমনটাই মনে করছেন ইতিহাসবিদ থেকে শিক্ষাবিদদের একটা বড় অংশ।

Advertisement

এমন মনে করার কারণ কী?

ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন, যে ভাবে মুখে কাপড় বেঁধে, হাতে লাঠি নিয়ে হস্টেলে ঢুকে হামলা চালানো হয়েছে তা পূর্ব পরিকল্পিত না হলে সম্ভব নয়। লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে, সময় ধরে হামলা চালানো হয়েছে। এটা ছাত্র রাজনীতির চরিত্র নয়। শিক্ষাঙ্গনে রক্তপাতের চিরাচরিত ধরন নয় এটা। ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলছেন, ‘‘হামলার ধরন দেখলেই বোঝা যাবে, এর ব্ল‌ু-প্রিন্ট অনেক আগে থেকেই তৈরি ছিল। সংগঠিত ভাবে তা শুধু বাস্তবায়িত করা হয়েছে। এককথায়, অতীতে শিক্ষাঙ্গনে যত গোলমাল হয়েছে, সে দিক থেকে জেএনইউ-এর হামলা নজিরবিহীন। এ রকম কোনও ঘটনা আগে আমি অন্তত মনে করতে পারছি না।’’

Advertisement

আর এক ইতিহাসবিদের কথায়, ‘‘ক্লাসিক্যাল ফ্যাসিজ়মের একটা চরিত্রই হল, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিবান মহলের যাঁরা প্রতিবাদ করছেন তাঁদের উপরে হামলা করা। যেখানেই যাঁর বিরুদ্ধ স্বর, সেখানে তাঁকে দমিয়ে দাও। এটা ফ্যাসিজ়মের চরিত্র। তারই নতুন রূপ দেখা গেল রবিবার রাতের ঘটনায়। না হলে মুখে কালো কাপড় বেঁধে ঢুকে পরপর হস্টেলে হামলা চলতে পারে না।’’

নকশাল আমলেও শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত হয়েছিল। কিন্তু তার পিছনে ছাত্র রাজনীতি ছিল বলেই জানাচ্ছেন অনেকে। তৎকালীন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় জানালেন, নকশাল আমলে শিক্ষাঙ্গনে যে সব হামলা হয়েছিল তার অধিকাংশই ছিল ছাত্র রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সে কারণেই হামলা, সে কারণেই ভাঙচুর আর রক্তপাত। কিন্তু জেএনইউয়ে যা হল, তার সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির কোনও যোগই নেই। অসীমবাবুর কথায়, ‘‘প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর দমিয়ে দাও, এটাই ছিল হামলার মূল চরিত্র। কোনও মতাদর্শের বিরোধ নয়, এখানে একটাই নীতি কাজ করেছে। যেখানে যেখানে বিরোধীরা রয়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করো ও দমিয়ে দাও। না হলে এ ভাবে অবাধে ঢুকে হামলা চালানো যায়? যেখানে বাদ পড়েনি মেয়েদের হস্টেলও!’’

শিক্ষাবিদদের একাংশও মনে করছেন, এই হামলা নজিরবিহীন। বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি, সেগুলিকে একত্রিত করে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এই হামলা কোনও না কোনও সময়ে ঘটতই— এমনই মত তাঁদের। শিক্ষাবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘৩৭০ ধারা বিলোপ, অযোধ্যা রায়, এনআরসি— এগুলিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখলে দেশের বর্তমান অবস্থা বোঝা যাবে না। বরং এগুলো একত্রিত করলে দেখা যাবে, কোথাও একটা নির্দিষ্ট ধরন (প্যাটার্ন) কাজ করছে। যার সম্মিলিত ফল জেএনইউয়ে হামলা।’’ এই হামলার পিছনে দীর্ঘ পরিকল্পনাও কাজ করেছে বলে জানাচ্ছেন তিনি। এত দিন রাষ্ট্রযন্ত্র অনুকূলে না থাকায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সেই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে বলেই জানাচ্ছেন সৌরীনবাবু। রজতকান্তবাবুরও মত, ‘‘হামলার কত ক্ষণ পরে পুলিশ ঢুকবে, কী বলা হবে, কী ভাবে হামলার ঘটনা অস্বীকার করা হবে— সবই আগে থেকে ঠিক করা। হঠাৎই বদলে যাওয়া দেশে অচ্ছে দিনের নয়, হামলার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হচ্ছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement