জিতেন্দ্র তিওয়ারি ও তবসসুম আরা
বিজেপিকে ধরাশায়ী করার পরে মেয়র বাছার মধ্যে দিয়ে আসানসোলে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করে দিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রাক্তন মেয়র তথা বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এ বারও পদের প্রধান দাবিদার বলে দলের একাংশ দাবি করে আসছিল, তিনি নন। আর এক দাবিদার বলে যাঁর নাম উঠে আসছিল, শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের ভাই সেই অভিজিৎ ঘটকও নন। মঙ্গলবার কলকাতার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে নব নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠকের পরে মমতা জানিয়ে দিলেন, আসানসোলের মেয়র হচ্ছেন জিতেন্দ্র তিওয়ারি। ডেপুটি মেয়র প্রায় অচেনা তবসসুম আরা।
সেই জিতেন্দ্র তিওয়ারি, যিনি গত পুরবোর্ডে দক্ষতার সঙ্গে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন। ফলে নাগরিকদের চাহিদা ও সমস্যার ঠিকুজি-কোষ্ঠী যাঁর বিলক্ষণ জানা। জিতেন্দ্র তিওয়ারি, যিনি তাপস বা মলয় কারও গোষ্ঠীতেই পড়েন না। কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপির শক্তির বড় ভিত যে হিন্দিভাষীরা, তাঁদের মধ্যে যাঁর যথেষ্ট প্রভাব।
সেই জিতেন্দ্র তিওয়ারি, গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে যিনি নানা ভাবে জেরবার করেছেন বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়কে। বাবুলের বিরুদ্ধে প্রচারের সময়ে মদ খেয়ে মন্দিরে ঢোকা থেকে শুরু করে অস্ত্র রাখা পর্যন্ত একের পর এক অভিযোগ দায়ের করে গিয়েছেন তাঁর অনুগামীরা। বাবুল সাংসদ হওয়ার পরেও এই টক্কর জারি থেকেছে। ফলে, মমতা কার্যত এক ঢিলে তিন পাখি মারলেন বলে মনে করছেন শিল্পাঞ্চলের তৃণমূল নেতারা। এক, তাপস বা অভিজিতের মধ্যে এক জনকে মেয়র করলে যে কাজিয়া জিইয়ে থাকত, বিধানসভা ভোটের আগে তা এড়িয়ে গেলেন তিনি।
দুই, যে শিল্পাঞ্চলের ভোটারদের অর্ধেকেরও বেশি অবাঙালি, সেখানে প্রথম কোনও অবাঙালিকে মেয়র করে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করলেন মমতা। যাতে হিন্দিভাষীদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল ফের মাথা তুলতে না পারে। দলের আসানসোল জেলা সভাপতি ভি শিবদাসনের বক্তব্য, ‘‘লোকসভা নির্বাচনে অবাঙালি ভোটের একটা বড় অংশ আমাদের হাত থেকে চলে গিয়েছিল। পুরভোটে তা আবার ফিরে এসেছে। তাকে সম্মান জানানো উচিত বলে নেতৃত্বের মনে হয়েছে।’’ তিন, জিতেন্দ্র তিওয়ারির সক্রিয় বিজেপি-বিরোধিতার জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করা হল, যাতে দলের অন্য নেতাদের কাছেও তাঁর পন্থা অনুসরণীয় হয়। যে কারণে খবর শুনেই দিল্লি থেকে বাবুল বলেন, ‘‘আমাকে মারতে আসা থেকে শুরু করে মদ্যপানের অভিযোগ— কী করেননি জিতেন্দ্রবাবু! হয়তো সেই সব সুকর্মেরই পুরস্কার পেলেন।’’ রাজ্যের পরিস্থিতি ‘সন্ত্রাসঘন’ বলে দাবি করে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘এর পরে তো রাজ্য নির্বাচন কমিশনার করা উচিত অনুব্রত মণ্ডলকে!’’ প্রত্যাশিত ভাবেই, দলনেত্রীর এই সিদ্ধান্তে মুখ ভার তৃণমূলের অনেক প্রভাবশালী নেতার। এমনকী এ হেন অঘটনের জন্য ঘনিষ্ঠ মহলে বর্ধমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকেও দুষছেন অনেকে। তবে প্রাক্তন মেয়র তাপসবাবু বলেন, ‘‘দল যেমন ভাল বুঝেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত শিরোধার্য।’’ একই সুর অভিজিৎবাবুর গলাতেও। অরূপবাবুর দাবি, ‘‘দলের নেতৃত্ব ও বিধায়কদের সঙ্গে কথা বলে নেত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে আমরা সবাই খুশি।’’ কোনও বিতর্কে না ঢুকে জিতেন্দ্রবাবু শুধু বলেন, ‘‘নেত্রীর নির্দেশ মেনেই কাজ করব।’’
চেয়ারম্যান পদে মমতা বসিয়েছেন গত বারের ডেপুটি মেয়র অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর মনোনয়ন নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও ডেপুটি মেয়র পদে তবসসুম আরার নির্বাচনে চমকে গিয়েছেন অনেকেই। তবসসুম রাজনীতিতে আনকোরা। তাঁর স্বামী, কুলটির নেতা মহম্মদ আসলাম টিঙ্কু ‘মহিলা সংরক্ষিত’ ওয়ার্ডে দাঁড়াতে না পারায় তাঁর জায়গায় তবসসুমকে দাঁড় করানো হয়েছিল। তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতার ব্যাখ্যা, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তাঁদের ফল আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। ফলে, সংখ্যালঘু মন জয়ের বাধ্যবাধকতা ছিলই। তবসসুমের বাড়তি সুবিধা, তিনি মহিলাদেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন। নেত্রী আসলে আসানসোলের বড় পদগুলিতে হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি, পুরুষ-মহিলার একটা সামঞ্জস্য তৈরির চেষ্টা করেছেন। তা ছাড়া, কুলটি থেকে এক জনকে বড় পদ দিতেই হত। কেননা কুলটির নেতা তথা বিধায়ক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়কে এ বার টিকিট দেয়নি দল। এই নিয়ে শহরে ক্ষোভ রয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেতার স্ত্রীকে ডেপুটি মেয়র করে তা প্রশমিত করারও চেষ্টা হল তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি। উজ্জ্বল শুধু বলেন, ‘‘নেত্রীর সিদ্ধান্তে আমরা খুশি।’’
সাবেক আসানসোল পুরসভার সঙ্গে কুলটি, রানিগঞ্জ ও জামুড়িয়া পুরসভা যোগ করে এই আসানসোল কর্পোরেশন গড়া হয়েছে। বামেদের হাতে থাকা রানিগঞ্জ ও জামুড়িয়াতেও এ বার ভাল ফল করেছে তৃণমূল। ১৬ অক্টোবর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হতে পারে বলে সূত্রে খবর।