বাবা তপন অধিকারীর দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ছেলে। বৃহস্পতিবার মালবাজারে। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক
‘পাগলা বান’ এসেছিল মহালয়ার দিনও। ভেঙে দিয়েছিল অস্থায়ী বাঁধ। স্থানীয় মানুষজনই সে কথা জানাচ্ছেন বার বার। তার পরেও সেখানে বাঁধ তৈরি করে বিসর্জনের ব্যবস্থা হয়েছিল। বুধবার, দশমীর সন্ধ্যায় সেই বাঁধ ভাসিয়ে দিল আর একটি হড়পা বান। স্থানীয়দের কথায় যা ‘পাগলা বান’। আট জনের মৃত্যু হয়েছে সেই ঘটনায়। জখম হয়েছেন ৩০ জন। পুলিশ সূত্রে দাবি, এখন আর কেউ নিখোঁজ নেই। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের গাফিলতি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এই ঘটনা।
কী ভাবে এমন ঘটল? নবান্ন সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এই ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। তিনি জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর সঙ্গে কথাও বলেন বলে সূত্রের দাবি। জেলার বিসর্জনের ঘাটগুলির পরিকাঠামো এবং নিরাপত্তা বন্দোবস্ত যথাযথ রয়েছে কি না, তা পরিদর্শনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্রের খবর, অন্য দিকে, জেলা প্রশাসনের তরফে নবান্নকে দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাল এলাকায় কোনও বৃষ্টি হয়নি, তবে মাল নদীতে হড়পা বান হয়েছে (ভুটান থেকে জলপ্রবাহ আসে), তাতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নদীতে তিন গুণ জল বেড়ে যায়। তাতেই এই দুর্ঘটনা। যদিও প্রকাশ্যে এই নিয়ে জেলা প্রশাসন কিছুই বলতে নারাজ।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা সত্ত্বেও কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রথমত, যেখানে মহালয়ার আগের দিনই হড়পা বান হয়েছে মাল নদীতে, ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে অস্থায়ী বাঁধ এবং বাঁধ তৈরির কাজে পাথর তোলার জন্য
নদীখাতে নামানো একটি ট্রাক, সেখানে ফের সেই বাঁধ তৈরি করা হল? কেন এত দর্শনার্থী এবং প্রতিমাবাহী লরিকে সেখান দিয়ে নদীর মাঝের চরটিতে যেতে অনুমতি দেওয়া হল? প্রশাসনের দিক থেকে যে সচেতনতা থাকা উচিত ছিল, তা দেখা গেল না কেন? দ্বিতীয়ত, মালবাজারে নবমীর দিনও বৃষ্টি হয়। পাহাড়ে তো নিয়মিত বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। তা হলে কেন সে দিকে নজর দেওয়া হয়নি? তৃতীয়ত, মাল নদীর ঘাট তৈরির দায়িত্বে ছিল মাল পুরসভাও। নবমীর বৃষ্টিতে জল বেড়ে যায়। দিনভর ঘাট তৈরির কাজ করতে হয় পুরকর্মীদের। তখনও কেন টনক নড়েনি?
জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা এই নিয়ে কিছু বলতে চাননি। মালবাজারের চেয়ারম্যান স্বপন সাহা বলেন, ‘‘পাহাড়ি মাল নদীকে বাগ মানানোর কোনও চেষ্টা আমরা করিনি। আমরা দীর্ঘদিনের প্রথা মেনে যে ভাবে ঘাট করা হয়, সেটাই করেছিলাম।’’ বিরোধীরা যে এই নিয়ে অভিযোগের আঙুল তুলছে প্রশাসনের দিকে, তা নিয়ে স্বপনের বক্তব্য, ‘‘এ নিয়ে রাজনীতি করা বেদনাদায়ক।’’
যদিও পুরসভা এবং প্রশাসনের থেকে দূরত্ব তৈরি করেছেন জেলা পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘নদীতে কীসের বাঁধ কোথায় দেওয়া ছিল সেই বিষয়ে জানা নেই।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘মাল নদীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, গত কুড়ি বছরের রেকর্ডে এমন ঘটেনি। পর্যাপ্ত সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ করে জল বেড়ে যায়, প্রায় তিরিশ জন ভেসে যান। আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন আর কোনও নিখোঁজের খবর নেই। তবে এনডিআরএফ তল্লাশি চালাচ্ছে।’’
মালবাজারের ঘটনা নিয়ে টুইট করে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের তরফ থেকে মৃতদের পরিবার পিছু দু’লক্ষ টাকা এবং জখমদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করা হয়েছে। একই হারে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে রাজ্যের তরফেও। রাজ্যের তরফে আপৎকালীন ফোন লাইনও চালু করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, হড়পা বান আসার পরে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ এবং প্রশাসন। মোট ৭০ জনকে উদ্ধার করা হয়। তা নিয়েও কটাক্ষ রয়েছে বিরোধীদের। অভিযোগ, সেই সময়ে দেখা যায়, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর হাতে ছিল শুধু দড়ি। যদিও সেই দড়ি ধরে কোনও মতে জল পার হয়ে বাঁচেন অনেকে।
বিজেপি অভিযোগ করে, ক্ষতিপূরণের যে চেক এ দিন সকলের হাতে তুলে দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন, সেটি আসলে কেন্দ্রের পাঠানো টাকা। যদিও জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এটা রাজ্যের দেওয়া ক্ষতিপূরণই।