জলপাইগুড়ি আদালত চত্বরে রঞ্জন শীলশর্মা। — নিজস্ব চিত্র।
তিনি প্রকাশ্যে শিলিগুড়ি শহরে মিছিল করলেও পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায়নি। সেই তিনি, শিলিগুড়ি পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জন শীলশর্মা শুক্রবার জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনও পেয়ে গেলেন!
অথচ রঞ্জনবাবু ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে একটি ব্যবসায়ী সমিতি দখলের জন্য কয়েক জন ব্যবসায়ীকে মারধর করে রক্ত ঝরানোর অভিযোগ রয়েছে। এ দিন ওই ঘটনায় অভিযুক্ত রঞ্জনবাবু-সহ ছ’জন জেলার মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আত্মসমর্পণ করেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ভূমিকায়। কারণ, রঞ্জনবাবুদের বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ দায়ের করেছে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা! বিরোধীরা তাই বলছেন, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার মতো এখানেও পুলিশের দু’মুখো নীতি। শাসকদলের কেউ অভিযুক্ত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে লঘু ধারা দেওয়া হয়। অভিযোগকারীদের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টো! রায়গঞ্জ থেকে মাজদিয়া, বীরভূম থেকে আলিপুর—সর্বত্র একই ছবি বলে অভিযোগ বিরোধীদের।
রঞ্জনবাবুদের জামিনের আবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে কোনও পক্ষের আপত্তিও এ দিন শোনা যায়নি। আদালত ছ’জনেরই জামিন মঞ্জুর করেছে বলে জানান সরকারি আইনজীবী শান্তা চট্টোপাধ্যায়। রঞ্জনবাবুর আইনজীবী দ্রুতি রায়ের দাবি, “আমার মক্কেলদের বিরুদ্ধে ১৪৩, ১৪৮, ১৪৯, ৩২৫ এবং ৫০৬ ধারায় মারামারি, হুমকির মামলা রুজু করা হয়েছে। সব ক’টি জামিনযোগ্য। আদালত ধারা দেখে জামিনের আর্জি মঞ্জুর করেছে।” আইনজীবীদের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, ৩২৫ ধারায় (কাউকে গুরুতর জখম করা) দেওয়া হলে অভিযুক্তের জামিনের বিরোধিতা করতেই পারেন সরকারি আইনজীবী। ঠিকমতো সওয়াল করলে জামিন খারিজও হতে পারে।
তা হলে তিনি কেন আদালতে রঞ্জনবাবুদের জামিনের আবেদনের বিরুদ্ধে সওয়াল করলেন না, সে প্রশ্নের জবাবে সরকারি আইনজীবীর যুক্তি, পুলিশ অভিযুক্তদের নিজেদের হেফাজতে চায়নি বলেই তিনি জামিনের বিরোধিতা করেননি। অন্য দিকে, আক্রান্ত ব্যবসায়ীদের আইনজীবী শঙ্কর দে বলেছেন, “জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হওয়ায় আমরা আপত্তি জানালেও তা ধোপে টিকত না। তাই বিরোধিতা করিনি।”
ঘটনাটি মঙ্গলবার রাতের। শিলিগুড়ি পুরসভার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের (এখানকারই কাউন্সিলর রঞ্জনবাবু) ঘোঘোমালি নেতাজি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির কর্তা মণীন্দ্রনাথ সাহার অভিযোগ, ওই রাতে রঞ্জনবাবু দলবল নিয়ে ব্যবসায়ী সমিতির অফিসে হামলা চালান। লাঠি, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে
কয়েক জন গুরুতর জখম হন। মণীবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতে তৃণমূল কাউন্সিলর-সহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অন্য দিকে, রঞ্জনবাবুর অনুগামী বলে পরিচিত, এলাকার ব্যবসায়ী দিলীপ সেন মারধর, সোনার হার ছিনতাইয়ের অভিযোগ দায়ের করেন মণীবাবু-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ কিন্তু জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করেছে।
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী শঙ্করবাবুর দাবি, “পুলিশ শাসক দলের হয়ে কাজ করেছে। রঞ্জনবাবুদের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করা উচিত ছিল। সেটা না করে উল্টে চার জন জখম ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই জামিন-অযোগ্য ধারা দিয়েছে।” একই সুরে সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকারের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলের শাসনে পুলিশ দলদাসে পরিণত হয়েছে। যাঁরা আক্রান্ত, তাঁদের বিরুদ্ধেই জামিন-অযোগ্য ধারা দেওয়া হল। পুলিশের এই ভূমিকার জন্যই রাজ্যের সর্বত্র তারা মার খাচ্ছে।’’
লঘু ধারা প্রয়োগের অভিযোগ মানতে চাননি শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা। তিনি বলেন, ‘‘অভিযোগের ভিত্তিতে ধারা দেওয়া হয়। তা ছাড়া, আদালতে আহতদের মেডিক্যাল রিপোর্টও পেশ করতে হয়। সে সবের উপরেও অনেক সময় জামিন মঞ্জুর বা নাকচ হওয়া নির্ভর করে। তদন্ত এখনও চলছে। লঘু ধারা দেওয়ার অভিযোগ সত্যি নয়। তবু, বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’’ রঞ্জনবাবুদের কেন হেফাজতে চাওয়া হয়নি, সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। পুলিশের আরও বক্তব্য, আহত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোনার হার ছিনতাইয়ের মতো অভিযোগ থাকায় ৩৭৯ ধারা (জামিন-অযোগ্য) দেওয়া হয়েছে।