কাঁধে চেপে আসছেন রাজরাজেশ্বরী।
বেলা পড়ে আসছে। শরতের সাদা মেঘ আঁকিবুকি কাটছে আকাশে। দূর থেকে ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বহুদূর থেকে নদীপথে নিজের বাড়িতে ফিরছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। মন উদভ্রান্ত তাঁর। আজ দশমী। এইবছর রাজরাজেশ্বরী মায়ের মুখ দেখা হয়নি তাঁর। মুর্শিদাবাদের নবাব কর না দেওয়ার অভিযোগে বন্দি করে রেখেছিলেন তাঁকে। নবাব জানতেন পুজোর সময় রাজাকে আটকে রাখলে দ্রুত কর আদায়ে সুবিধা হবে। হলও তাই। রাজাকে মুক্ত করতে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা কর উঠে এল দ্রুত। প্রজা-পরিজন-বন্ধুরা হাত বাড়িয়ে দিল। পুজোতে তাঁরা তাঁদের রাজাকে ফেরত চান।
একদম নবমীর দিন শেষবেলায় কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দিলেন নবাব। অধীর আগ্রহে এই দিনটার দিকে তাকিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। বিসর্জনের আগে একবার অন্তত দেবীর মুখদর্শন করতে চান তিনি। বিসর্জনের সময় হয়ে আসছে। ঢাক ঢোলের শব্দ, প্রজাদের কোলাহল কানে আসছে তাঁর। রাজবাড়ির কাছে পৌঁছলেন কৃষ্ণচন্দ্র। জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে দেবীকে। ডুবে যাচ্ছে মূর্তি। কৃষ্ণচন্দ্র কাছে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে দেবীর চোখটুকুও ডুবে গেল জলে। নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন রাজা। মাকে পুজো করা হয়নি, অঞ্জলি দিতে পারলেন না— সব মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু একবার চোখের দেখাও দেখতে পেলেন না দেবীকে!
জলস্পর্শ করলেন না তিনি। সেদিন রাজবাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছেন, এমন সময় স্বপ্নে এক অপরূপ সুন্দরী কিশোরী মূর্তি দেখা দিল। তাঁর আভায় চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে গেল। ক্রমে সেই মূর্তি মিলিয়ে গেল। তাঁর জায়গায় দেখা দিল রক্তম্বুজা চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি। সেই মূর্তি সিংহবাহিনী। দেবীমূর্তি রাজাকে বললেন, কুমারী রূপে ঠিক একমাস পরে তিনি আবার আসবেন রাজার কাছে। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে সপ্তমী অষ্টমী নবমী, এই তিন দিন তাঁর পুজো করার আদেশ দেন রাজাকে।
আরও পড়ুন:দূষণে মুখ ঢেকেছে দিল্লি, সবুজায়নে আট হাজার কোটি লগ্লির প্রতিশ্রুতি আঙ্গেলার
আরও পড়ুন:সন্দেশখালিতে দুষ্কৃতী ধরতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ ৩ পুলিশ, চলছে ধড়পাকড়
ঘুম ভেঙে চমকে উঠে বসলেন রাজা। কে এই দিব্যদর্শন কন্যা? তিনি ছুটে গেলেন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। তিনি বললেন, এই দেবী চণ্ডীরই রূপ। এর পুজো কর। তোমার দুর্গাপুজো না-করার কষ্ট দূর হয়ে যাবে। অনুগতরা তাঁকে পরামর্শ দিল কিছুদিন এখন রাজবাড়ি থেকে দূরে থাকতে। নবাব যদি খবর পান, রাজা ফিরে এসে পুজোর প্রস্তুতি করছেন তাহলে ফের বিপদ হতে পারে। রাজবাড়িতে আর ঢুকলেনই না রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। সেখান থেকেই তিনি সোজা চলে গেলেন চন্দননগরে তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চোধুরীর কাছে।
গোপাল ভাঁড় আর কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র পুজোর আয়োজন করতে লাগলেন। নবমীর দিন গোপনে রাজবাড়িতে ফিরে এসে সোজা পুজোর ঘরে ঢুকলেন রাজা। পুজো শেষে অঞ্জলি দিলেন। মায়ের মূর্তি দেখে রাজার ক্ষোভ প্রশমিত হল। দেবীমূর্তি সিংহের ওপর দু’দিকে পা দিয়ে বসে। চার হাতে শঙ্খ চক্র তির ও ধনুক। সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো। বলা হয়, হিরণ্যকশিপুকে শ্রীকৃষ্ণ বধ করেছিলেন এই রূপে। এটি নৃসিংহ মূর্তি। কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাস করতেন তাঁদের দুর্গা মা-ই আবার অন্য রূপ ধরে ফিরে এসেছেন। তাই দুর্গামূর্তির মতো জগদ্ধাত্রী মূর্তিকেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে বলা হয় রাজরাজেশ্বরী।
যদিও ঠিক কোন সময়ে কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দু’বার মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতে বন্দি হন। প্রথম বার ১৭৫৪, মতান্তরে ১৭৫৬ সালে। দ্বিতীয় বার ১৭৬৩ বা ’৬৪ সালে। গবেষকদের মতে, প্রথম বার তিনি আলিবর্দির হাতে বন্দি হয়েছিলেন।যদিও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তরপুরুষ মণীশচন্দ্র রায়ের মতে, রাজকর বকেয়া রাখার অজুহাতে সিরাজ তাঁকে বন্দি করেন।তাঁর কথায়, সেই সময় ফারসিতে লেখা রাজসভার কার্যাবলী ও অন্যান্য ঘটনার বিবরণ যা এখনও তাঁদের কাছে পারিবারিক সূত্রে রক্ষিত রয়েছে, সেই বিবরণ অনুযায়ী ১৭৫৬ সাল, অর্থাৎ সিরাজের রাজত্বকালে কৃষ্ণচন্দ্র বন্দি হন।রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্য চরিত্রম’ বইয়ে লিখেছেন, সিরাজের দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে তৎকালীন বিভিন্ন প্রভাবশালী লোক কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পরামর্শ চান। কৃষ্ণচন্দ্রের উপস্থিতিতেই সিরাজকে গদিচ্যুত করে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র হয়। কাজেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং সিরাজের মধ্যে দ্বৈরথের সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করে দেওয়া যায় না।
আর একটি মত অনুযায়ী, ১৭৬৩ বা ’৬৪ সালে মীরকাশিমের আমলে কৃষ্ণচন্দ্র বন্দি হয়েছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যোগাযোগ আছে এই সন্দেহে মীরকাশিম কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গের দুর্গে বন্দি করে রাখেন। কিছু কিছু গবেষকের মতে, সেখান থেকে ফেরার সময় রকুনপুরঘাটের কাছে নৌকার মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় দেবী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন।
জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমীতে ক্রমান্বয়ে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর পুজো হয় রাজবাড়িতে। পুজোর সময়ে ঠাকুরঘর থেকে নারায়ণ শিলা নামিয়ে আনা হয় ঠাকুরদালানে। কৃষ্ণচন্দ্রের নিজস্ব উপসনার জন্য একটি জগদ্ধাত্রী মূর্তি ছিল। সেটি রাখা হত গোবিন্দবাড়িতে। দেশভাগের সময় যখন হঠাৎ কৃষ্ণনগর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায় তখন এই বিগ্রহও চলে যায় সেখানে। মূর্তিটি ভেঙে প্রায় নষ্ট দেয় দুষ্কৃতীরা।রানি জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং রাজা সৌরীশচন্দ্রের উদ্যোগে ফের যখন কৃষ্ণনগরের সংযুক্তি ঘটে এ দেশের সঙ্গে তখন ভাঙা মূর্তিটি ফেরত পায় রাজপরিবার। এবার পুজোয় সেইমূর্তিটিও ঠাকুরদালানে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজপরিবারের সদস্যরা।
সপ্তমী পুজোর সময় দেবীকে পায়েস, মিষ্টি, দুধ, ছানা, ফল, বাদাম, কিসমিস, কাজু, মেওয়া দেওয়া হয়। অষ্টমী পুজোর সময় দেওয়া হয় খিচুড়ি, তরকারি, মিষ্টি, চাটনি। নবমীর পুজোতে দেওয়া হয় পোলাও ও নানা রকম তরকারি। এ ছাড়াও ভোগে দেবীকে তিন থেকে পাঁচ রকমের মাছ দেওয়া হয়।
বহুকাল আগে কৃষ্ণনগরের মালোপাড়ার পুজোতে অনুদান দেওয়ার প্রথা শুরু করেছিলেন মহারাজ শ্রীশচন্দ্রের স্ত্রী বামাকালী দেবী। পনেরো টাকা অনুদান দেওয়া হত সেই সময়। সেই প্রথা এখনও চলছে। রাজবধূ অমৃতা রায় প্রতিবছর মালোপাড়ায় অনুদান দেন। বিসর্জনের সময় রাজবাড়ির চকের সামনে থেকে ঠাকুর ঘুরিয়ে রানিদের দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রথাও বহুদিনের। এখনও সব ঠাকুর এখান থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে তবেই বিসর্জন হয়। রাজপরিবারের সদস্যরা চক থেকে ওপর থেকে ঠাকুর দেখেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায় অনেক কিছুই। কিন্তু কৃষ্ণনগরের প্রতি উৎসব প্রবাহমান সময়কে যেন স্থির করে দেয় রাজবাড়ির দরজায়!
ছবি-সংগৃহীত