গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লক্ষ্য বাংলার ‘জিহাদ বাজার’। সেই বাজারের দখল নিতেই তৈরি হয়ে গিয়েছে জামাতুল ইসলাম ইন্ডিয়া। অন্য দিকে রয়েছে জামাতুল ইসলাম বাংলাদেশের নব্য শাখা যাঁরা নব্য জেএমবি বলে বেশি পরিচিত।
সামনে এরা থাকলেও, নেপথ্যের লড়াইটা কিন্তু গোটা বিশ্বের দুই ত্রাস ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং আল কায়দার। আশঙ্কাটা অনেক দিন ধরেই করছিলেন গোয়েন্দারা। সেই আশঙ্কাই এখন বাস্তব পশ্চিমবঙ্গের বুকে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সূত্রে এ রাজ্যে প্রথম বিষয়টি সামনে আসে। বাংলাদেশের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র দু’টি আলাদা অংশকে ব্যবহার করেই এখানকার মাটিতে নিজেদের সংগঠন মজবুত করতে চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক ওই দুই জঙ্গি সংগঠন। তাদের উৎখাত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আইএস বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত রিটা কাটজ্ তাঁর একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ইরাক এবং সিরিয়াতে পরাজয় নিশ্চিত বুঝেই আইএস ‘গ্লোবাল জিহাদ’ ধারণার জন্ম দেয়। সেই সময় থেকেই সংগঠনের মুখপত্র দাবিক-এ তাঁরা বাংলাদেশে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানান দেয়। ঘোষণা করে তাঁদের বাংলাদেশ সংগঠনের আমির বা প্রধানের সাংগঠনিক নামও। এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের একাধিক ব্লগার এবং বিদেশি খুনের দায় নেয় আইএস। প্রাথমিক ভাবে আইএসের কোনও উপস্থিতি খুঁজে না পেলেও, পরবর্তীতে বাংলাদেশ পুলিশ জানতে পারে, ওই দেশের সক্রিয় দুই জঙ্গি সংগঠন আনসারুল বাংলা টিম এবং জেএমবি-র একটি অংশের সঙ্গে আদর্শগত গাঁটছড়া বেঁধে নিজেদের সাংগঠনিক অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আইএস।
আরও পড়ুন: সেনার পোশাকে অপহরণ! নিউ আলিপুরের ব্যবসায়ী পালিয়ে বাঁচলেও, অপহৃত তিন সঙ্গী
তত দিনে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্র ধরে জেএমবি-র একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী নেটওয়ার্কের হদিশ মেলে এ রাজ্যেও। জানা যায়, জেএমবি-র প্রথম সারির প্রায় সমস্ত নেতাই এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গা ঢাকা দিয়ে বাংলাদেশে তাঁদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ এবং রাজ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেএমবি-র বেশ কিছু মাঝারি মাপের নেতা। জানা যায়, জেএমবি-র ‘সুরা’ (সংগঠনের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী কমিটি)-তে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চলছে আদর্শগত সঙ্ঘাত। তত দিনে ঘটে গিয়েছে ঢাকার হোলি আর্টিজান কাফেতে হামলার ঘটনা। প্রকাশ্যে এসেছে জেএমবি ভেঙে তৈরি হয়েছে নব্য জেএমবি সংগঠন, যারা আইএস মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় মোস্ট ওয়ান্টেড নব্য জেএমবি-র সোহেল মেহফুজ ওরফে হাতকাটা নাসিরুল্লা যে বাংলাদেশে ওই হামলার পিছনে থাকা মূল মাথা তা কিন্তু তখনও ভারতীয় গোয়েন্দাদের জানা ছিল না।
কাফে হামলার তদন্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা জানতে পারেন, সেখানে ব্যাবহৃত অস্ত্র এবং বিস্ফোরক এসেছিল ভারতের মুঙ্গের থেকে। সে সব এ রাজ্যের মালদহ হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আমের ঝুড়ির আড়ালে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জে। এনআইএ-র এক গোয়েন্দা বলেন, ‘‘তত দিনে আদর্শগত মতপার্থক্যে কোণঠাসা হয়ে পুরনো সঙ্গীদের ছেড়ে ফের বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সোহেল মেহফুজ।’’ অন্য দিকে, বাংলাদেশে ভাল সংগঠন তৈরি করে ফেলেছে নব্য জেএমবি। ফলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে জেএমবি-র আদি শাখা।
কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-র এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ফেরার জেএমবি নেতাদের খোঁজ করতে গিয়েই মুর্শিদাবাদে হদিশ মেলে একটি নতুন মডিউলের। যারা বুদ্ধগয়াতে হামলার ছক কষেছিল দলাই লামার সফরের সময়ে।” ওই এসটিএফ কর্তা আরও বলেন, ‘‘মডিউলটি প্রকাশ্যে আসতেই জানা যায়, বাংলাদেশে কোণঠাসা হয়ে এ রাজ্যে ঘাঁটি গেড়েই বুদ্ধগয়াতে হামলার ছক করেছিল খাগড়াগড় বিস্ফোরণের আর এক মোস্ট ওয়ান্টেড জহিদুল শেখ ওরফে কওসর।” আর তার পিছনে মূল মাথা ছিল সালাউদ্দিন সালেহিন বা বড় ভাই।
আরও পড়ুন: অশ্লীল নাচে লোকসভা ভোটের বিজয়োৎসব, ভাঙড়ে বিতর্কে তৃণমূল
সম্প্রতি একটি অডিয়ো বার্তায় সালাউদ্দিন সালেহিন আইএস মতাদর্শে অনুপ্রাণিত দলের নব্য অংশের কড়া সমালোচনা করেছেন এবং তাঁদের সঙ্গে জেএমবি-র কোনও সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছেন। তিনি ওই অডিয়ো বার্তায় জানিয়েছেন, জিহাদের মাটিকে মজবুত করতেই গঠন করা হয়েছে জেএমবি-র হিন্দ বা ভারত শাখা। এ বছর মে মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করেছে জেএমবি-র বিভিন্ন মডিউল। সালাউদ্দিনের এই আদি জেএমবি গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী আল কায়দার আদর্শে বিশ্বাসী।
মঙ্গলবার কলকাতায় ধৃত নব্য জেএমবি-র চার সদস্য এবং বেঙ্গালুরুতে ধৃত খাগড়াগড় কাণ্ডের অন্যতম ওয়ান্টেড হাবিবুর রহমান শেখকে জেরা করেও উঠে এসেছে ওই দুই সংগঠনের এ রাজ্যে জমি শক্ত করার একাধিক তথ্য। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, দুই সংগঠনেরই আন্তর্জাতিক যোগ রয়েছে এবং তারা জিহাদের নামে পশ্চিম এশিয়া থেকে পাচ্ছে বিপুল আর্থিক সাহায্য! কেন্ত্রীয় এক গোয়েন্দা বলেন, ‘‘অসম, বাংলা এবং ত্রিপুরাতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক যে ধর্মীয় মেরুকরণ হয়েছে, সেটাকে হাতিয়ার করে প্রত্যন্ত গ্রামে নিজেদের ভিত শক্ত করছে জেএমবি।’’
এসটিএফের এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘নব্য জেএমবি ভারতের মাটিকে কাজে লাগাচ্ছে মূলত ক্যাডার নিয়োগ এবং সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি ও আশ্রয়ের জন্য। কারণ, তাদের অপারেশনের মূল এলাকা এখনও বাংলাদেশ। অন্য দিকে, আদি জেএমবি এ রাজ্যকেই বর্তমানে সদর দফতর হিসাবে ব্যবহার করে ভারতে অপারেশন করার লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্যে ওরা রোহিঙ্গাদেরও ব্যবহার করছে।” গোয়েন্দাদের দাবি, সালাউদ্দিন সালেহিন এ দেশেই রয়েছে। অন্য দিকে সোহেল মেহফুজ বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়ার পর, চট্টগ্রামের ডন নিযুক্ত হয়েছে নতুন আমির হিসাবে। সে বাংলাদেশে থাকলেও, নব্য জেএমবি-র সুরার অধিকাংশ নেতাই এ রাজ্যে। এনআইএ সূত্রে জানা গিয়েছে, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর বেঙ্গালুরুর কাছে কেআর পুরমে গা ঢাকা দেয় হাবিবুর। সেখানে বাংলাভাষী শ্রমিকদের মধ্যে মিশে যায় সে। সেখানে থাকাকালীন কর্নাটকের রাইচুড় জেলার এক মহিলাকে বিয়ে করে ডোদাবলপুরে ঘাঁটি তৈরি করে সে। কওসর ও বড়ভাইয়ের সঙ্গেই সে হয়ে ওঠে জামাতুল ইসলাম হিন্দ বা ভারত শাখার অন্যতম প্রধান সংগঠক।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একটি অংশের দাবি, খাগড়াগড়ের ধাক্কা সামলে দুই জেমবি-র অন্তত ৩০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছে এ দেশের এই তিন রাজ্যে। দফায় দফায় তাদের দেওয়া হচ্ছে সামরিক প্রশিক্ষণও। ধীরে ধীরে ইসলামিক জঙ্গি কার্যকলাপের মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ।