ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঠাকুরদাস বাড়িতে নেই। রামজয় ছুটলেন। খবরটা যে এখনই দিতে হয়। পথেই ছেলের সঙ্গে দেখা। “একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে।’’ ঠাকুরদাস জানতেন গোয়ালে একটি গাভী গর্ভবতী। এ তো বেশ ভাল খবর। ঘরে পৌঁছেই সোজা ছুটলেন গোয়ালে। ছেলের কাণ্ড দেখে রামজয় তর্কভূষণের হাসি আর দেখে কে! “ও দিকে নয়, এ দিকে এস, আমি তোমায় এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিতেছি।” নিয়ে গেলেন আঁতুড়ঘরে। একটি ফুটফুটে সদ্যোজাত সন্তান। পিতৃত্বের অহঙ্কারে হাসি ফুটল বাবার মু্খেও। বাবার পুরো নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ছেলের নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছোটবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ভয়ানক দুরন্ত। মারধর, বকাবকি, কিছুতেই তাঁকে থামানো যেত না। ঠাকুরদাস তখন আত্মীয়-পরিজনদের জড়ো করে বাবার গল্পটি শোনাতেন। “ইনি হলেন সেই এঁড়ে বাছুর, বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু, তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন, তাঁহার পরিহাস বাক্যও বিফল হইবার নহে, বাবাজি আমার, ক্রমে, এঁড়ে গরু অপেক্ষাও একগুঁইয়া হইয়া উঠিতেছেন।”
বাবার নির্দেশ অমান্য করতে পারলেই পরম তৃপ্তি মিলত ঈশ্বরের। বিনয় ঘোষের লেখাতেই আছে, বাবা স্নানের কথা বললে দু’-তিন দিন পুকুরের ধারকাছ মারাতেন না! আর যে দিন মানা করতেন সে দিন তাঁকে কোনও ভাবেই পুকুর থেকে তোলা যেত না! তবে শাসন বারণও কিছু কম ছিল না! শোনা যায়, টিকি বেঁধে রাখার আসল কারণ নাকি মোটেও অধ্যবসায় নয়। বাবার মারের হাত থেকে রেহাই পেতেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন ঘুমকাতুরে ঈশ্বরচন্দ্র।
আরও পড়ুন: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘নায়ক’
ঈশ্বরচন্দ্রের পরীক্ষা ভীতি ছিল ভয়ানক। পরীক্ষার সময় এলেই তাঁর টিকির নাগাল পাওয়া যেত না! এ দিক-ও দিক পালিয়ে বেড়াতেন। একরকম জোর করেই ভয় কাটিয়েছিলেন শিক্ষক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। রচনা লিখতে হবে ঈশ্বরচন্দ্রকে। বিষয় ‘সত্যকথনের মহিমা’। প্রেমচন্দ্র রীতিমতো ধরেবেঁধে পরীক্ষায় বসালেন। পরীক্ষায় তো বসলেন, কিন্তু কিছুতেই আর লেখা আসেনা! অবশেষে অনেক ভাবনাচিন্তার পর লেখা এলো। ছাত্রটি ধরেই নিয়েছিলেন, লেখা পড়ে নির্ঘাত তিরস্কার জুটবে! কিন্তু কি আশ্চর্য। শুধু প্রশংসা নয়! মিলল ১০০ টাকা পুরস্কার। ঈশ্বরচন্দ্রের পরীক্ষা ভীতি কেটে গেল।
সেই ঈশ্বরচন্দ্রই বাংলা গদ্যের ভিত গড়ে দিলেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলায় শিল্পসম্মত গদ্যরীতির উদ্ভব হল। মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থের ভাষা রীতির দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। উপযোগবাদ নিষ্ঠ ঈশ্বরচন্দ্র মনে করতেন, নিছক সাহিত্য সৃষ্টি নয়, লোকহিত করাও অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ভাবনা ঠিক হোক বা ভুল! বিশুদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টির অসামান্য ক্ষমতা সত্ত্বেও তিনি সমাজকল্যাণের অভিমুখ বেছে নিয়েছিলেন। এ কম উদারতার পরিচয় নয়! রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিন্যস্ত করিয়া তাহাকে সহজগতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন-এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাবপ্রকাশের কঠিন বাধা পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন- কিন্তু যিনি এই সেনানীর রচনাকর্তা, যুদ্ধ জয়ের যশোভাগ সর্বপ্রথম তাঁহাকে দিতে হয়।’
এহেন ঈশ্বরচন্দ্রের ব্যক্তিজীবন যে খুব একটা সুখের ছিল এমন নয়! বিধবা বিবাহ নিয়ে লড়ছিলেন বটে কিন্তু ভেতরটা ক্রমশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল! সময়টা ১৮৬৯। ক্ষীরপাই গ্রামের মুচীরাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদা বিধবা মনমোহিনীর বিয়ে। সব ঠিকঠাক। খবর পেয়েই গ্রামে ছুটে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর আনন্দ আর দেখে কে! কিন্তু হালদারেরা দলবেঁধে দেখা করলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে। অনুরোধ,যাতে বিয়ে না হয়। ঈশ্বরচন্দ্র মেনে নিলেন। বিয়ে হবে না! বিদ্যাসাগর বাধ্য হয়ে মনমোহিনী ও তাঁর মা’কে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। এ যন্ত্রণা তিনি আজীবন ভুলতে পারেননি!
ছেলের ক্ষেত্রেও ঘটল এমনই এক দুঃখজনক ঘটনা! স্ত্রী, মা, পরিবার সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলের সঙ্গে এক বিধবার বিয়ে দিলেন। মনে পুলকে ভরে ছিল। তিনি ভাবতেও পারেননি যে, মাত্র দু’বছরের মাথায় সেই ছেলেকেই তিনি ত্যাজ্য করবেন!
২৯ জুলাই, তাঁর ১২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এত দিন পরেও এই মহান ব্যক্তিত্বের কথা ভাবলে মনে হয়, ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত ক্ষয়িষ্ণু হতে হতেও মানুষটি লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে কখনও সরে যাননি। যত ঝড়ঝাপ্টাই আসুক, নিজের সংকল্পে তিনি অটুট ছিলেন আজীবন!