গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দিনবদলের গান ছেড়ে কি গানবদলের দিন?
হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীদের জায়গায় অরিজিৎ সিংহ এবং কেকে? ‘পথে এবার নামো সাথী’ বা ‘শঙ্খচিল’-এর বদলে ‘লহরা দো’? ধীরে ধীরে কি সাংস্কৃতিক লাইনে বদল আনতে শুরু করছে রাজ্য সিপিএম? ধারাবাহিক ভাবে দলের ‘অফিশিয়াল’ ফেসবুক পেজ থেকে যে ধরনের রিল্স আপলোড করা হচ্ছে, যে যে গান ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে এই প্রশ্ন তুলছেন দলেরই অনেকে। কেউ বলছেন, নতুনকে আত্মস্থ না করলে টিকে থাকা যাবে না। কারও বক্তব্য, গণসঙ্গীতের ধ্রুপদী ঘরানা থেকে ধীরে ধীরে বার হতে থাকলেও একটা সময়ে নাড়ির টান ছিঁড়ে যাবে। ফলে রিল্সে গানের ব্যবহার নিয়ে দলের মধ্যে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই মনোভাবই রয়েছে। যা বলে দিচ্ছে, বিতর্ক এবং মন্থনও হচ্ছে সিপিএমের অন্দরে।
সিপিএমের যুব সংগঠন ‘ইনসাফ যাত্রা’ করছে। সেই কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রণ নিয়ে খুশি নেতারাও। সেই ইনসাফ যাত্রার বিভিন্ন ফুটেজকে রিল্স আকারে ফেসবুক পেজে তুলছে সিপিএমের আইটি সেল। সেখানে যেমন ব্যবহার করা হচ্ছে কবীর খান পরিচালিত ‘৮৩’ ছবিতে অরিজিৎ, প্রীতমের গাওয়া ‘লহরা দো’, তেমনই ‘ইকবাল’ ছবিতে প্রয়াত কেকে-র গাওয়া গান। এমন অজস্র রিল্সের আবহে বাজছে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির গান। দিনক্ষণ, পরিপার্শ্ব দেখে এ-ও স্পষ্ট, সুপরিকল্পিত ভাবেই রিল্সে ওই গান ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘৮৩’ ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ জেতা নিয়ে। কপিল দেব নিখাঞ্জ ছিলেন সেই দলের অধিনায়ক। বিশ্বকাপ জয়ের আবহে মূলত কপিলের বায়োপিক ছিল ‘৮৩’। এ বারও ভারতীয় ক্রিকেট দল বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যেতে হয়। আমদাবাদে সেই ম্যাচের আগেও ওই গানটি বাজানো হয়েছিল স্টেডিয়ামে। পাশাপাশিই, সে দিন সকালে যখন সিপিএমের যুবরা ইনসাফ যাত্রা শুরু করেছিলেন, দেখা গিয়েছিল সকলের গায়ে রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের নীল জার্সি। সেই ফুটেজই যখন রিল্স আকারে ছাড়া হয়েছে, তখন দেখা যাচ্ছে তাতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘৮৩’ ছবির সেই গানটি।
যদিও দলের তরফে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, পুরনো ঘরানাকে অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পলাশ দাস বলেন, ‘‘কমিউনিস্ট আন্দোলনে সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরা শাশ্বত। তা থেকে সরার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে নতুন আঙ্গিককে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রিল্সে এই ধরনের গান ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ গণনাট্য সংঘের রাজ্য সভাপতি তথা চিকিৎসক হিরণ্ময় ঘোষাল বলেন, ‘‘গণসঙ্গীতের প্রবাহ থেকে দল সরে আসবে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সমাজমাধ্যম একটা নতুন পরিসর। সেখানে নতুন প্রজন্মের ব্যবহারকারীই বেশি। সে কারণেই এই উপাদানগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে মনে হয়।’’ সিপিএমের আইটি সেলের এক সদস্যের কথায়, ‘‘রিল্সে যে ধরনের গান ব্যবহার করলে রিচ বৃদ্ধি পায়, আমরা সেই গানই ব্যবহার করছি। কিন্তু সেখানে রুচিবোধের বিষয়টাও মাথায় রাখা হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ইনস্টাগ্রামে এটা বেশ কিছু দিন ধরেই চলছে। তবে যে হেতু ফেসবুকে সদ্য শুরু হয়েছে, তাই নজরে পড়ছে।’’
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। সফদর হাশমি থেকে উৎপল দত্ত, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটকদের নাম জড়িয়ে রয়েছে আইপিটিএ-তে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নকশা নিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে মত এবং পাল্টা মতের তর্কও সুবিদিত। সেই প্রেক্ষাপটে এই রিল্সের যুগে বাজারচলতি হিন্দি গানের ব্যবহার নিয়ে কেউ কেউ যেমন ভ্রু কুঁচকোচ্ছেন, তেমনই কেউ কেউ আবার বলছেন, পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ না খাওয়ালে ‘ডারউইনবাদ’কে অস্বীকার করা হবে। সিপিএমের নেতারাও মেনে নিচ্ছেন, এ নিয়ে দলে মত এবং পাল্টা মত থাকবে। সেটা অমূলক নয়। তবে সমাজমাধ্যমকে যদি কৌশলে ব্যবহার না করা যায়, তা হলে হয়তো আবার দশ বছর পরে গিয়ে বলতে হবে ‘ঐতিহাসিক ভুল’!